নারী দিবস প্রসঙ্গ : জীবনের লক্ষ্য (Women's Day Context : Goal of Life)
মানুষের জীবনের পরম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হলো শান্তিময় জীবন। প্রত্যেকেই চায় সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে এবং কল্যাণমুখী কর্মধারায় বৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে।বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিময় জীবন পেতে গেলে ব্যক্তির পারিবারিক শান্তিময় জীবন কাম্য। এই জীবন আবার সমাজ দ্বারা প্রভাবিত। কারণ পারিবারিক-সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। আর সমাজ নামক রথ দুটো চাকার সাহায্যেই চলে। এই দুটো চাকা হল নারী এবং পুরুষ। নারী-পুরুষ উভয়ই উভয়ের পরিপূরক। কেউ ছোট বা বড় নয়। দুজনেই স্বাধীন সত্তা বিশিষ্ট। কিন্তু দৈহিক ও মানসিক গঠনস্বাত্যন্ত্রে ভিন্ন প্রকৃতির। নারী প্রকৃতি স্বরূপা, নমনীয়, সেবাপরায়ণ, উৎপাদনে সক্ষম ও শ্রীমন্ডিত। সৌন্দর্য্যময় পরিবার হতে গেলে যেমন নারীর প্রীতি, মমতা, উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রয়োজন তেমনি পুরুষের আদর্শনিষ্ঠা,পুরুষচিত বৈশিষ্ট্য,শাস্ত্র বিষয়ক জ্ঞান, কর্ম ,চিত্তসংযম,বাহ্যেন্দ্রিয় দমন, লৌকিক আচার পালন প্রভৃতি প্রয়োজন, তবেই আমাদের ধূলিমলিন গৃহাঙ্গন শুচিশুভ্র মঙ্গলতীর্থে এবং শান্তির স্বর্গ হয়ে উঠবে। পবিত্র আত্মিক ঔজ্জ্বল্যে নারী-পুরুষ উভয়ই সমুদ্ভাসিত হয়ে দিব্যসংস্কারসম্পন্ন সন্তানের জন্ম দেবে। যার চারিত্রিক প্রভায় বসুন্ধরা হবে ধন্য, সমাজ হবে নির্মল, নিষ্কলুষ। স্বামী বিবেকানন্দ,বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস প্রমূখ মহাপুরুষগণ তারই পরিচয় বহন করে।
বর্তমান পারিবারিক-সামাজিক জীবনে নেমে এসেছে সমস্যা জর্জরিত সংকট। চিরকাল যে মানবতার বাণী সময়ের সরণী বেয়ে চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরে, সেই কল্যাণী বাণীই যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকগণ তাঁদের কাব্য, সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। সেই পথ অনুসরণেই জীবন চলমান। জীবন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সচল ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। ব্যক্তির জীবন পরিবর্তনশীল কিন্তু শান্তির অন্বেষাই একমাত্র লক্ষ্য মানুষের সুতরাং পরিবর্তন যাই হোক না কেন, ব্যক্তিকে তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়,নচেৎ দুরবস্থা চরমে উঠতে বাধ্য।
আজ পারিবারিক জীবনে শুধুই অর্থ,কাম ও স্বার্থের সংঘাত। নারী-পুরুষ উভয়ই স্বধর্ম চ্যূত। নারী যেমন প্রকৃত নারী হয়ে ওঠার ঝোঁক ত্যাগ করে স্বাধীনতা ও অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তেমনি পুরুষও তার আদর্শনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ইত্যাদি গুণাবলী হারাতে বসেছে। বিশেষতঃ যীশুখ্রিস্টের জন্মের সাড়ে চার হাজার বছর আগে ইউরেশিয়া থেকে একদল যাযাবর জাতি ইন্দো-ইউরোপীয় অঞ্চলে অভিযানের কাল থেকে অর্থাৎ গ্রীকদের সময় থেকে নারী-পুরুষ দ্বৈত সম্পর্কের ধারণা চলে আসছে। অনেকের মতে,ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যুক্তিবাদী যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মে নারীদের উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রাধান্য দৃঢ় হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নারী নির্যাতন, শোষণ, নারীর দাসত্ব থেকে মুক্তির দাবী আজ প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষিত হয় তার দু'বছর আগে ১৯৭২ সালে Miriam Schneir এর লেখা Feminism: The Essential Historical Writings গ্রন্থটিতে নারীমুক্তির যে ধ্বনি প্রাধান্য পেয়েছিল তা-ই আজ নারীবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আমরা বেদ, উপনিষদে নারীর স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত যে ছিল, সে সময়কার সামাজিক কাঠামোতে প্রমাণ পেয়েছি, সীতা, সাবিত্রী গার্গী, মৈত্রী,অপালা,বিশ্ববারা প্রমূখ প্রাচীনকালের এই নারীগণ তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁরা সমাজে যথাযোগ্য মর্যাদা, পুরুষের সমান স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতেন তখন পুরুষও তাঁর শাস্ত্র বিষয়ক কর্ম পালনে জ্ঞানালোকিত কর্ম করতেন। নারী ও পুরুষ উভয়েই উভয়ের পরিপূরক ছিল। নারীর মর্যাদা দিতেও তারা সক্ষম এবং সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে পুরুষ তার চারিত্রিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন না করে কেবল ক্ষমতার অপব্যবহার করে নারীকে শোষণ,নির্যাতন করে চলেছে। নারী অবলা,কম বুদ্ধিসম্পন্ন, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ও পুরুষের কামনা,বাসনা চরিতার্থতাই তাঁদের একমাত্র কর্ম বলে মনে করতেন।ফলের নারী ধীরে ধীরে তাঁদের ক্ষমতার নিষ্পেষণে কোণঠাসা অসহায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত বধূহত্যা, খুন, ধর্ষণ, কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রভৃতি অপকর্ম অনায়াসেই সংঘটিত হচ্ছে। তাই আজ সময় এসেছে, এই ৮ই মার্চ নারী দিবসে পরিবার, সমাজ গঠনে নারী-পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
সমাজ সংস্থিতির মূলে নারী, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। নারী কখনো দুহিতা, ভগিনী, জায়া, জননী কখনো বা গৃহিণী রূপে সংসারকে ধরে রেখেছে আজ পর্যন্ত। তাঁর পুষ্টি, প্রেরণা, সেবা-যত্ন, মমতায় সংসার হয়ে ওঠে শান্তির স্বর্গ কিন্তু আজ সংসারে নারী-পুরুষ উভয়ই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অধঃপতিত। তাই এখন গৃহ হয়ে উঠেছে গর্ত। আর এই গর্তে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত শান্তি। অনেক নারী মনে করে বিয়ে মানে দাসী হওয়া, সন্তান জন্ম দেওয়া মানে যান্ত্রিকতা। কিন্তু মা বা স্ত্রী হওয়া নারীর স্বভাবে ঈশ্বর গেঁথে দিয়েছেন তাঁর মধ্যে। তাঁর মধ্যে ভালোবাসার অংশ বেশি তাই আজও সংসার টিকে আছে। স্নেহ আছে বলেই সন্তানের সেবা করে অনায়াসে, প্রেম আছে বলেই স্ত্রী সেবা করে স্বামীর, এতে দায় নেই। দায় হয় তখনই যখন স্নেহপ্রেমের সম্বন্ধ স্বাভাবিক হয় না। ভালোবাসা ধর্মই আত্মসমর্পণে এবং গৌরব তাতেই।
বিধি সম্মত বিয়েই দাম্পত্য জীবনের শান্তি ও সুখের আকর। বিয়ে শুধু আচার সর্বস্ব সামাজিক অনুষ্ঠান নয়, দুটো মানুষের মনের মিল। কিন্তু অনেক নারী বিয়ে ব্যাপারটাকেই স্বীকার করতে চান না। আসলে পরস্পরের মনের মিলে যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে তা জীবনকে করে মধুময়, শান্তিময়। নিবিড় প্রাণের টানে দুটি হৃদয়কে করে এক অথচ অনেকের মতে বিয়ে মানে বন্ধন, বন্দিজীবন, যেখানে স্বাধীনতা নেই কিন্তু বিয়ের বন্ধন আচার সর্বস্বতার নয়, ভালবাসার, যা শুধু কাছে পাওয়া নয়, পরস্পরের এষণা,অভিপ্সা। এই এষণা না থাকায় নারী নিজেকে মনে করে স্বামীর দাসী, ফলে সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ আর এই বিদ্বেষ জাত সন্তানও হয়ে ওঠে প্রাণহীন বিদ্বিষ্ট যন্ত্র।
এই বিষময় ফলে সমাজের নৈতিক অধঃপতন। একদিকে সমান অধিকারের দাবিতে নারী নিজের বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে অন্যদিকে পুরুষও তাঁর ক্ষমতার দর্পে নৈতিকতা বর্জিত তাই শুধু নারী নয় পুরুষকেও হয়ে উঠতে হবে আদর্শনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ন প্রকৃত পুরুষ। যেদিন থেকে নারী-পুরুষ হয়ে উঠবে আদর্শনিষ্ঠ সেদিনই সমাজ আবার শান্তির স্বর্গ হয়ে দেখা দেবে। সমাজে নারীকে তার সহজাত সংস্কার সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। নারীর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে অন্যদিকে পুরুষকেও নারী সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। নারী অবলা, অবহেলার পাত্র, উপেক্ষা ইত্যাদি সংকীর্ণ মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে। মাতৃজ্ঞানে নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। অবশ্য পুরুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব নিতে হবে নারীকেই। কারণ নারীর মতো সর্বংসহা শক্তি পুরুষের নেই, পুরুষ স্থানু,স্থবির।নারী জঙ্গম,চলিষ্ণু,প্রকৃতির মতো।অমিত শক্তির অধিকারী। সেই শক্তিতে পুরুষকে উজ্জীবিত,সঞ্জিবীত করতে পারে একমাত্র স্নেহশীল নারী। কারণ এই ক্ষমতা নারীর সহজাত। সে ক্ষেত্রে নারীর অসম্মান বা দায়ের প্রশ্ন অবান্তর।নারী চিরকাল মাতৃস্বরূপা। অমিত শক্তিধারিনী ও সহানুভূতিশীল নারীর চারিত্রিক গুণে সে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট পুরুষের আশ্রয় স্বরূপ বটবৃক্ষের শীতল ছায়া দান করতে পারে।
এখানে স্বধর্মাচারণেই তার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও গৌরব। জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে সংসারকে সুন্দর ও সুমধুর শান্তিময় করে গড়ে তুলতে নারী। এ প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ বহুল প্রচলিত, 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে' এটুকুই বহুল প্রচলিত অথচ পরের অংশটুকু হল 'জ্ঞানবান পতি যদি মিলে তাঁর সনে' অর্থাৎ পুরো প্রবাদটির অর্থ হলো সংসার সুখের হবে তখনই যখন তার সঙ্গে আদর্শপরায়ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমন্বিত জ্ঞানপ্রাপ্ত পুরুষের সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হবে। এছাড়াও শুধু নারী স্বধর্ম চারিনী হলে হবে না, পুরুষকেও তার ধর্মে সঠিক থাকতে হবে। সঠিক পুরুষের গুণ সুপ্ত থাকে একটি শিশুর মধ্যে অর্থাৎ প্রকৃত নারী এবং প্রকৃত পুরুষ হয়ে ওঠার যে গুণ তা শৈশবে মা-বাবাকেই তার আচার-আচরণের মধ্যে চাড়িয়ে দিতে হবে চর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে।
পারিবারিক সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশে যদি শিশুর অন্তর্নিহিত গুণাবলী সযত্নে বিকশিত হয় তাহলেই সেই ছোট্ট শিশু একদিন পরিপূর্ণ পুরুষ কিংবা নারী হয়ে উঠতে পারবে এবং নারী-পুরুষের নীতিসম্মত বৈবাহিক জীবনের সুন্দর নিবিড় ভালোবাসায় যে সন্তানের জন্ম হবে সে অবশ্যই সমাজের কর্ণধার হয়ে উঠবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তার দক্ষতায় গড়ে তুলবে সুস্থ ও নিষ্কলুষ সমাজ। নারী দিবসের পূণ্য লগ্নে আমাদের প্রত্যেকের তাই আজ এই অঙ্গীকারে বদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে, বর্তমান বিপর্যস্ত অধঃপতিত বিশৃংখল সামাজিক পারিবারিক পরিস্থিতি থেকে উন্নত জীবনের সান্নিধ্যে আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে আগে প্রয়োজন ব্যক্তিকে আদর্শনিষ্ঠ হওয়া। এক্ষেত্রে পুরুষ কিংবা নারী এককভাবে নয়, উভয়কেই হতে হবে আদর্শবান। নারী দিবস অর্থ শুধু নারীর কথা আসবে তা নয়, পুরুষের কথাও এ প্রসঙ্গে অবশ্যই আলোচ্য কারণ সমাজ নামক রথের দুটি চাকার একটি নারী এবং একটি পুরুষ।পুরুষ ছাড়া যেমন নারীর ভূমিকা নয় তেমনি নারী ছাড়া পুরুষ একক শক্তিতে সমাজ ব্যবস্থা চলতে পারে না। তাই কি পরিবারে কি সমাজে, সর্বাগ্রে এই নারী-পুরুষ উভয়কে হতে হবে নৈতিক গুনাবলী সমন্বিত।
আজ বিশৃংখল সমাজ সামনে, তার গোড়াতে হাত দেওয়া প্রয়োজন। গোড়ায় গলদ বলেই আজ এই অবস্থা। আমাদের উদ্দেশ্য যদি হয় সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি পাওয়া তাহলে এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে পরস্পর কালিমালিপ্ত না করে বরং বন্ধুর মতো সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহনশীল মানসিকতা পোষণ করাই বাঞ্ছনীয়। নারী-পুরুষ উভয়েই স্বাধীন সত্ত্বায় জ্ঞান আলোকিত পদক্ষেপে যখন সমাজ গঠন করবে তখনই সেই সমাজ হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গসুন্দর অর্থাৎ চারিত্রিক স্ববৈশিষ্ট্যে নারী-পুরুষ আদর্শ সমাজ এবং স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন জীবন করতে পারে অতিবাহিত।
প্রবন্ধঃ- নারী দিবস প্রসঙ্গ : জীবনের লক্ষ্য - (Women's Day Context : Goal of Life - Essay )
তাং--০৮-০৩-২০২০
স্থান- রায়গঞ্জ।
No comments:
Post a Comment