Unique Great man Ishwar Chandra Vidyasagar Essay by Poet Khushi Sarkar
অদ্বিতীয় মহাপুরুষ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবন্ধটি লিখেছেন কবি খুশী সরকার
প্রবন্ধ - অদ্বিতীয় মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
খুশী সরকার
"তরবোহপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।"
যে মনন ক্রিয়া হল মনের জীবন, সেই জীবনই যোগবশিষ্ঠ মনুষ্যত্ব। আর সেই মনুষ্যত্ব যিনি আজো অভ্রংলিহ স্বর্ণচূড়া তিনিই হলেন অলোকসামান্য পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ঘোচান শত শতাব্দীর কুসংস্কারদীর্ণ আমাদের সমাজ অচলায়তনের অন্ধকার, বিস্তার করেন শিক্ষার আলো, আর্ত জনতার হৃদয়ে় সঞ্চার করেন করুণার অমৃত বারি, ঐতিহ্যের করেন নব মূল্যায়ন, তিনি সেই একক, অদ্বিতীয় বিরলতম ব্যক্তিত্ব যিনি অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক মরুভূমির দেশে মানবতার মন্দাকিনী প্রবাহিত করে দিয়ে আমাদের মুক্তি দেন।
বাস্তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জাতির স্পন্দনহীন দেহে প্রাণের স্পন্দন সঞ্চারিত করবার জন্যেই যে কঠিন সব সাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন তাতে তিনি সিদ্ধিলাভ করে যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার গৌরব মুকুটে জাতিকে সম্মানিত করেছিলেন তাতে বিস্মরণশীল বাঙ্গালী বিস্মৃত হলেও কালের দেবতা বিস্মৃত হননি। তাই মৃত্যুর দুই শত বৎসরেও ধনীকের অট্টালিকা থেকে দরিদ্রের পর্ণকুটির পর্যন্ত আজও তার জন্য পাতা হয় মহামানবের বন্দনায় সম্মানিত আসন, হৃদয়হীন অকৃতজ্ঞতার অন্তরেও বেজে ওঠে কৃতজ্ঞতার অশ্রু ধৌত মর্মর ধ্বনি। সমগ্র ভারতবর্ষেই বিদ্যাসাগরের নাম আজ সসম্মানে উচ্চারিত হয়। তাঁর নামের সঙ্গে মিশে আছে এক অতি মানবিক আলো। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় নিত্য স্মরণীয় পুণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিন্তু তিনি শুধু করুণাসাগর বা বিদ্যাসাগর রূপেই পরিচিত নন, তাঁর পরিচয় তাঁর প্রবল মনুষ্যত্ব। বাস্তবিকই এত বড় মাপের মানুষ স্মরণকালের মধ্যে ভারতবর্ষের মৃত্তিকায় জন্মগ্রহণ করেন নি, তাঁর সমস্ত ক্রিয়াকর্ম- যা দুর্বার আন্দোলনের আকারে এই গতিহীন সমাজকে সহসা চঞ্চল করে তুলেছিল। তার উৎস তাঁর সেই দুর্জয় মনুষ্যত্ব। তাঁর সূচিত ও পরিচালিত সকল সমাজ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ যেমন ছিলেন তিনি একা তার সেই সমস্ত আন্দোলনের কর্মীদল বলতে যা কিছু তাও তেমনি ছিলেন তিনি নিজে এবং একা।
দরিদ্র ও রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র পিতার হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিলেন নবযুগের কর্মভূমি কলকাতায় পিতার বাসনা ছিল মেধাবী পুত্র উপযুক্ত সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করে স্বগ্রামে কিরে চতুষ্পাঠী খুলে সগৌরবে বিদ্যা দান করুক। আজন্ম সংগ্রামী পুত্র পিতার সেই বাসনা পূর্ণ করেছিলেন।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ইশ্বরচন্দ্র অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান পণ্ডিত হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন স্মৃতি পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য 'আইন কমিটি' তাকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি দিয়েছিলেন তখন ভারতবর্ষে প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপ্রতিহত শাসন। পরাধীনতার সেই নীরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে এল নবজাগরণের জোয়ার।
'ন মেধয়ান বহুনা শ্রুতেন'- তিনি অসীম ক্ষমতা বলে তার চেতনার গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন ইংরেজ দাসত্ব নয় ইংরেজবাহিত পাশ্চাত্য শিক্ষায় এই মৃত জাতির নিঃসার দেহে প্রাণ সঞ্চারের সক্ষম এবং প্রবল প্রতাপান্বিত সাম্রাজ্যশক্তির সাহায্যে নারী নির্যাতন, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি বর্বর ও অমানুষিক সামাজিক অনাচারের বিলুপ্তি সম্ভব। চৈত্রের অনন্যসাধারণ পৌরুষ এবং অনমনীয় তেজস্বিতা গুনে তিমি বড় মাপের ইংরেজ তথা মার্শাল, ময়েট, বেথুন প্রমুখের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন ইংরেজ সমাজের উপর তার সেই দুর্জয় প্রবাদ কে কাজে লাগিয়ে সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে এনেছিলেন অভাবনীয় সাফল্য।
অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন দীর্ঘদিন। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই অভাগা দেশে বেদে ব্রাহ্মণদের কোন অধিকার ছিলনা। সেই ধারা অনুসারে এদেশের শুদ্ররা সংস্কৃত বিদ্যায় ছিল অন অধিকারী। সংস্কৃত কলেজ এর সূত্র ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিল নিষিদ্ধ। শিক্ষাক্ষেত্রে এই অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে বিদ্যাসাগরের সংস্কারমুক্ত বিবেকবোধ। তাই রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান হয়েও তিনি সংস্কৃত কলেজের আদর্শ বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সূত্র ছাত্রদের সামনে সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। তার এই রীতিবিরুদ্ধ কাজে বাঁধা এলেও তাকে এই সামাজিক অন্যায়ের বিলুপ্তি সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
বিধবা বিবাহের প্রবর্তনে তার জীবনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সৎকর্ম জননী ভগবতী দেবীর নির্দেশ অনুসারে এদেশের বালিকা বিধবাদের দুর্গতি মোচনের জন্য বিধবা বিবাহের প্রবর্তনকেই একমাত্র উপায় হিসেবে চিহ্নিত করলেন। রক্ষণশীল প্রাচীন সমাজে বিধবা বিবাহ প্রবর্তন তাঁর মত এক ব্রাহ্মণ সন্তানের পক্ষে ছিল এক অতি দুরূহ কর্ম সেজন্য তার শাস্ত্র বাক্যের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। পরাশর সংহিতায় তিনি সেই শাস্ত্র বাক্য সমর্থন আবিষ্কার করলেন।
'নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতো'।
'পঞ্চ স্বাপৎসু নারীনাম্ পতিরণ্য বিধীয়তে'-
তিনি যখন এই শাস্ত্র বচন সংগ্রহে ব্যস্ত তখন বাংলার নবযুবকেরা বিধবা বিবাহের সমর্থনে তিনটি সভা আহ্বান করেন কিন্তু অজ্ঞাত রহস্যময় কারণে তারাই বিদ্যাসাগরের সূচিত বিধবা বিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে বাঙালি চরিত্রের স্বকীয়তা রক্ষা করেছেন। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রয়াসে 1856 সালের 26শে জুলাই বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ হয়। শুধু এখানেই থেমে থাকেন নি, নিজ খরচে বিধবাদের বিয়ে দিতে তার ঋণ একসময় 82 হাজার টাকায় পৌঁছায়। এবং নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবার বিয়ে দিয়ে বিধবা বিবাহ কে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেন। বেন্টিঙ্ক এর সহায়তায় রামমোহন "সতীদাহ প্রথা" রদ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ নিবারণ করেন দূর করেন কৌলীন্য প্রথার পাপ।
সাড়ম্বরে বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ হলেও এই সনাতন সমাজে তা সাদরে গৃহীত হয়নি। বিদ্যাসাগর এবার নারী সমাজের এই চিরায়ত সমস্যার মূল উৎপাটনে জন্য বহুবিবাহ নিবারণের নতুন আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলন সফল না হলেও তার প্রভাব যে সমাজে ব্যর্থ হয়নি অর্ধশতাব্দী পরে বিধিবদ্ধ হিন্দু কোড আইনই তার প্রমান তাঁর 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিল। তিনি এই কুপ্রথা রহিত করবার জন্য এতই ব্যাগ্র ছিলেন যে তিনি গ্রন্থটির অনুবাদসহ ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সংকল্প করেন।
বাংলার স্ত্রীলোকের সামাজিক মর্যাদা, তাদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি সম্পর্কে বিদ্যাসাগর যতদূর করেছিলেন আর কেউ তা করেছিলেন কিনা সন্দেহ। একথা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে নারী শিক্ষার জাতীয় জাগরণ এবং সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের প্রধান শর্ত। শুধু তাই নয় দেশের শিক্ষা ব্যতীত জাতির পুনরুত্থানের যে আশা নেই ইশ্বরচন্দ্র তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন।
কেবলমাত্র একটি হিন্দু কলেজ বা সংস্কৃত কলেজ দিয়ে দেশব্যাপী অজ্ঞানতার বিশাল জগদ্দল পাথর থেকে অপসারিত করা সম্ভব নয় তাই তিনি গ্রামে গ্রামে কঠোর পরিশ্রমে সরকারি শাসনযন্ত্র ও সরকারি তহবিল কে কাজে লাগিয়ে বালক বিদ্যালয় এর পাশাপাশি নানা স্থানে স্থাপন করলেনরূপে অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয়। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী মডেল স্কুল স্থাপিত হলো অনেকগুলি। বিদ্যালয়গুলিতে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব দূর করবার জন্য অনেকগুলি নর্মাল স্কুল স্থাপিত হয়। এইভাবে তিনি দেশময় শিক্ষার একটি জাল বিছিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। জনগণের দুর্দশা মুক্তির জন্য সত্যদ্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরের পথকেই প্রকৃত পথ রূপে চিহ্নিত করেন। সে পথ হলো জনগণের সাক্ষরতা বিধান তথা সার্বজনীন শিক্ষার ভিত্তি রচনা। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রয়াসী হয়েছিলেন।
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল নতুন সমস্যা উপযুক্ত গ্রন্থাভাব। যে গ্রন্থ গুলি ছিল তা কালের বিচারে অবৈজ্ঞানিক, ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষা শৈলির সঙ্গে পরিচিত বিদ্যাসাগর বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থ রচনা করলেন। যেমন 'বর্ণপরিচয়' (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ), কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলী, বোধোদয় ও বাংলার ইতিহাস সহজ সরল বাক্য রচনার মধ্যস্থতায় নীতিবোধক গল্পরস পরিবেশনায়, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগর সুচিন্তিত শিক্ষা পরিকল্পনার পরিচয়বাহী বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা সমৃদ্ধ সাক্ষরতা বিষয়ক যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেরকম গ্রন্থ বাংলা ভাষায় আজও রচিত হয়নি।
বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিতে সাক্ষরতায় কেবল শেষ কথা নয়, সাক্ষরতার সঙ্গে চায় ব্যক্তির চরিত্র গঠন। ব্যক্তির চরিত্র সুগঠিত হলে সুগঠিত হবে জাতীয় চরিত্র। সুগঠিত হবে জাতি, সুগঠিত হবে মানুষ তাই তিনি বর্ণপরিচয়ে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে মন্দকে পরিহার করে ভালোর দিক থেকে তুলে ধরেছেন। তাঁর বর্ণপরিচয় হলো কথামালায় প্রবেশের ভূমিকা। গল্পকার ঈশপের নীতিগর্ভ অনুরোধ থাকলেও তাতে তার বিবেকের আনন্দ সংমিশ্রিত ছিল, তা গ্রন্থ পাঠে উপলব্ধ হয়। কথামালার কনফুসিয়াস, জরাথ্রুস্টের মত মানুষের চরিত্র শোধন ও চরিত্র গঠনে মহান সমাজগুরুর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। সামাজিক সদাচার শিক্ষাই এই মহান সমাজগুরুর হিতবাণী।
এইভাবে বিদ্যাসাগর অদ্বিতীয় মহাপুরুষ ও সমাজ সংস্কারক রূপে তখনকার ভারতবর্ষের মতো আত্মবিস্মৃত দেশে জাতির পুনরুত্থানের জন্য নিরক্ষতা দূরীকরণ, সাহিত্য সেবা, শিক্ষা বিস্তার, সদাচার প্রভৃতি বিষয়ে সংস্কার সাধন করে একটির পর একটি আলোকবর্তিকা জ্বেলে সমাজের অন্ধকার দূর করতে কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং নিজে চির অমলিন শিখারূপে 1891 সালের 29শে জুলাই নির্বাপিত হয়েছেন। তিনি মহান চরিত্রের যে অক্ষয় বট রোপণ করেছিলেন ভারতের মৃত্তিকায়, তা আজও ছায়া- সুশীতল তীর্থস্থান রূপে বাঙালি জাতির কাছে গর্বের বিষয় ও নিত্যস্মরণীয়।
Unique great man Ishwar Chandra Vidyasagar essay by poet Khushi Sarkar
রচনাকাল- তাং :- ২১-০২-২০২০
No comments:
Post a Comment