Women's Rights and Protection essay written by Khushi Sarkar.
নারীর সুরক্ষা ও অধিকার প্রবন্ধটির লেখিকা খুশী সরকার।
Women's Rights and Protection: নারীর সুরক্ষা ও অধিকার:
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অর্থ শাস্ত্রে বলা হয়েছে "চক্র মেকং ন বর্ততে" অর্থাৎ একচক্র রথ গমনের উপযোগী নয়, চক্রদ্বয়েরই সহায়তায় রথের গতি সম্ভব। সমাজ নামক রথের দুটি চাকা হলো পুরুষ ও নারী উভয়ের দ্বারাই তার গমনাগমন। নারীর সহযোগ ছাড়া সংসার যাত্রা অচল। মহাভারতে ও ভাগবত পুরাণে একই কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সমাজের উন্নতি-অবনতি পুরুষের মতো নারীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে রামায়ণ যুগ, পৌরাণিক যুগ, প্রাক্ কালিদাসীয় যুগ, কালিদাস এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নারী ছাড়া যে সংসার অচল বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা সবাই জানি, কবির ভাষায়, "এই পৃথিবীর যাহা কিছু ভালো, যাহা কিছু সুন্দর অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"।
বৈদিক পরিবারের মাতা রূপে নারী ছিল সবার উপরে স্মৃতি শাস্ত্রে বলা হয়েছে, "গর্ভধারণ পোষণাভ্যাং পিতুর্মাতা গরীয়সী" অর্থাৎ গর্ভধারণ ও পোষণ করার জন্য পিতার থেকেও মাতা অধিক পূজ্য। পত্নী রূপে নারীর স্থান পুরুষের থেকে কম ছিল না। সে সময় সস্ত্রীক পুরুষেরাই বৈদিক যজ্ঞকর্মে অধিকারী ছিল।
ঋকবেদে সতীদাহ প্রথা ছিল না বরং সেকালে পতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা ছিল এমনকি বৈদিক যুগে নারীরা ঋষিত্ব অর্জন করে মন্ত্র দ্রুষ্টির সম্মান লাভ করত। লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, রোমশা, শ্রদ্ধা,ঘোষা ঋষিত্ব অর্জনে উল্লেখযোগ্য নারী।
বলাবাহুল্য ভারতবর্ষে যৌথ পরিবারের ভিত্তি করে যে পুরুষশাসিত সমাজ গড়ে উঠেছিল সেখান থেকেই শুরু হয় লিঙ্গ বৈষম্যের। ফলে শ্রমবিভাজন। পুরুষরা বাইরের কর্মে নিযুক্ত থাকতো আর নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে সেবা, নিয়মনিষ্ঠা, সন্তান উৎপাদন ও পালনে ছিল নিযুক্ত। নারীরা তখন সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম, খৃষ্টান ও পার্সি নারীরাও পুরুষদের তুলনায় অধঃস্তন মর্যাদায় অবস্থান করতো। তাই ভারতীয় সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের ব্যবস্থা ছিল কিন্তু নারীদের উপর যে অবিচার চলছিল তা আজও বিশ্বায়নের তুরীয় অগ্রগতিতেও বর্তমান।
কি শিক্ষাক্ষেত্রে, কি রাজনীতিক্ষেত্রে, কি সমতার ক্ষেত্রে, নারী ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন কারখানা স্থাপিত হলে কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন শহরকেন্দ্রিক শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির সূচনা হয়, অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন প্রভাবিত নারীজীবন বাইরের কর্মজীবনে হয় ব্রাত্য এবং সংসারের কাজকর্মে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এক কথায় মৌর্য যুগ থেকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা নানাভাবে শোষিত ও অত্যাচারিত হয়েছে। আমরা সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর গল্পে নারীর নানাভাবে অত্যাচারিত রূপের বর্ণনা পাই। সবুজপত্রের কালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও 'হৈমন্তী', 'দেনাপাওনা', 'অপরিচিতা', 'শাস্তি' প্রভৃতি গল্পে নারীর অসহায় অবস্থা বর্ণনা করেছেন তবে সেখানে নারী ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছে।
আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কুসংস্কার ও অশিক্ষা পুরুষের ক্ষমতা নারীকে করেছে এক ঘরে। আজও একুশ শতকের সুশিক্ষিত সমাজ বধূ নির্যাতনের সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
নারীর এই দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানাভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলন করেন। নারী মুক্তির জন্য চায় তাদের আত্মসচেতনতা আর এর জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। তাই রামমোহন রায় 'সতীদাহ' নামক নিষ্ঠুর কুপ্রথাকে বন্ধ করেন অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 'বিধবা বিবাহ', 'বাল্য বিবাহ রোধ' 'বহুবিবাহ রোধ প্রভৃতি আন্দোলন করেন এবং নারী শিক্ষার জন্য বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য সাধারণ সভা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, নব অধিকার কমিশন, নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিশন প্রভৃতির মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার রক্ষার নানা বিষয়ে ব্যবস্থা করা হয়। তবুও নারীর অধিকার লঙ্ঘনের রেখাচিত্র ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। নারী নিগ্রহের চরম ঘৃণ্যরূপ হল ধর্ষণ। মূলতঃ যৌন নিগ্রহের প্রকাশের মধ্য দিয়ে ধর্ষিতাকে শারীরিক, মানসিক এবং সর্বোপরি সামাজিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে। আসলে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে পুরুষ তার ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছাকে বলবৎ করে।
গান্ধীজিও বলেছেন, নারী জাতি এই বহুবিধ সমস্যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে না পারলে নারীজাতির যেমন উন্নয়ন হবে না তেমনি ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থারও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন হবে না।
তাঁর মতে, নারীগণ যে পরিমাণে শিক্ষা লাভ করবে সেই অনুযায়ী তারা নিজেদের শক্তি সামর্থ্য ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল হবে এবং পুরুষ শাসিত সমাজের নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে, এমনকি গান্ধীজীর মতে, জগতে শান্তি লাভের পথ নারীই দেখাতে পারে। নারী জগতের নীরব নেত্রী ও মর্যাদার অধিকারী।
তাঁর মতে, পুরুষের মোহ জাল ছিন্ন করে নারী যখন পুরুষের আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিদ্রোহ করবে তখনই সামাজিক ব্যাধি গুলি থেকে সমাজ মুক্ত হবে স্বরাজ অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি নারী-পুরুষের সমানাধিকার মনে করতেন। তাছাড়া জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রেও তিনি নারীর স্বাবলম্বীকে সমর্থন করতেন।
কিন্তু নারীর দুর্দশা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। আসলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিংবা বুর্জোয়া ব্যবস্থা-- কর্তৃত্ব সেই পুরুষতন্ত্রের হাতেই। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা মানসিক ও শারীরিক পীড়ণ তাদের জবর দখল করে রেখেছে। এই বিশ্বায়নের যুগে নারী আরো বেশি বেশি পণ্য হয়ে উঠেছে। শহরের পার্টিগুলোতে স্বল্পবাস নারীদের ভিড়। বিশাল জগৎটাকে পুরুষের লালসার শিকার করে রেখেছে। পার্টি জাতীয় অনুষ্ঠানে কখনোই কোনো পুরুষকে স্বল্প পোশাকে দেখা যায় না, তাই নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে তার অধিকার রক্ষায়।
নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা বহুবিধ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আছে দ্বৈত দায়িত্বশীলতা। সাংসারিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে রাজনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে সাফল্যের সঙ্গে ভূমিকা পালন বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যথাযথ নিরাপত্তার অভাবে নারীদের পুরুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে হয়। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবেও যথাযথ জ্ঞান ও তথ্য সংক্রান্ত সচেতনতা দেখা যায় না নারীর মধ্যে। আর হয়তো এই অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার কারণে নারী পারিবারিক হিংসা, বধূ নির্যাতন, শারীরিক নিগ্রহ, অর্থনৈতিক নিগ্রহ, পণপ্রথা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও শোষিত হয়ে আসছে। গান্ধীজীর মতে, বিবাহ একটি ধর্মানুগত সংস্কার। আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিবাহের প্রকৃত আদর্শ। প্রকৃত বিবাহ কেবলমাত্র দৈহিক মিলনকেই নির্দেশ করে না, আধ্যাত্মিক মিলনই তার মূল লক্ষ্য ও আদর্শ।
আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি পরিবার আর পরিবারের ভিত্তি বিয়ে কিন্তু বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রধান ভিত্তি সম্পত্তির চিন্তা ও নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির, বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই এখানে উপেক্ষিত। তাই স্বাভাবিক যৌন মিলনে ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব। কিন্তু যৌন মিলনের সঙ্গে মনের মিলন না ঘটলে যৌন সংসর্গ যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। আর যান্ত্রিক মিলন কখনোই উন্নত মানব জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারেনা। এখন লিভ টুগেদার,স্টে টুগেদার ইত্যাদির ফলে সামাজিক সংস্কার, বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে অনেক নারী বিয়ের মোহে ঢুকে পড়ছে সে জীবনে অন্যদিকে পুরুষ ভাবছে এটাই সুযোগ। যত পারো দুয়ে নাও টাকাপয়সা, সম্পত্তি আর যৌনতা। আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার অভাবনীয় উন্নতি বিশেষতঃ বিশ্বায়নের সংস্কৃতি মুক্ত, পছন্দ সচেতন ও স্বাতন্ত্র্য প্রিয় মানুষের জন্ম দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে নারীকে হতে হবে সচেতন। নিজেকেই নিতে হবে নিজের দায়িত্ব। শিক্ষা ও আত্মবলে বলীয়ান হওয়া প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের মতে মেয়েদের শরীর এবং মনের প্রকৃতিপুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই বলিয়া তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে একথা মনে রাখতে হবে সমাজের একদিকে যেমন শারীরিকী বৃত্তি, জ্ঞানার্জনী বৃত্তি,কর্মকারিণী বৃত্তি এবং হ্লাদিনী প্রীতি দিয়ে যেমন নারী প্রকৃত নারী হয়ে উঠবে তেমনি অন্যদিকে পুরুষকে যথা স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান সত্যকথন, তপস্যা, বাহ্যেন্দ্রিয় দমন প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন ও সজাগ হয়ে যখন প্রকৃত পুরুষ হয়ে উঠবে তখনই সমাজে নারীর প্রকৃত সুরক্ষা সম্ভব এবং সমাজে সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সম্ভব হবে না রিওয়াজ শ্রেয় হয়ে উঠতে পারছেনা সমানাধিকারের বসে হৃদয়ের বন্ধন নেই। বন্ধনহীনতার আবেগে নিজেকেই নিজে করেছে নিরাপত্তাহীন। তাই তার প্রকৃত ধর্মাচরণ এবং নিজের প্রতি নিজের ভক্তি-শ্রদ্ধা উৎপাদনে সক্ষম হলেই নারীর সুরক্ষার প্রশ্নটিই অবান্তর হয়ে পড়বে।
Women's Rights and Protection Essay Written by Khushi Sarkar
তাং--০১-০২-২০২০
No comments:
Post a Comment