Hite Biparit Short Story by Khushi Sarkar
Hite Biparit Bengali Short Story by Khushi Sarkar
ছোটগল্প— হিতে বিপরীত
লেখক—খুশী সরকার
"আমার সব শেষ হয়ে গেল মা। পারলাম না, —পারলাম না সংসার করতে।"
মেয়ের কথা শুনে মনীষার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে মা, বল্ কি হয়েছে?"
সুজিত অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে চায়। আমি তোমাদের বলিনি, অনেকদিন আগে থেকেই একটু একটু শুনেছিলাম যে, ও অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসে। তারপর এক ঘনিষ্ঠ আপনজনের কাছে বাস্তবে যখন জানতে পারলাম তখন তো সব ছেড়ে চলে এলাম ওর কাছে মা। কিন্তু এসেও কোনো ফল হলো না। আমি আসার পর থেকেই ও এ বাড়িতে আসে না।"
"কোথায় থাকে। "কপালে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করে মনোরমা।
"ওই মেয়েটার কাছে। আমি তো তোমাদের ভালো করে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। তোমরা কি তাহলে ভালো করে খোঁজ নাওনি। শুনলাম আমাদের বিয়ের আগেও ওর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে এফেয়ার ছিল। মেয়েটি কেসও করেছিল ওর নামে। অনেক টাকা দিয়ে সেই কেস নাকি মিটমাট করে নিয়েছে। তোমরা ভালো করে খবর নিলে হয়তো আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট হত না।"
কিন্তু আমরা তো খবর নিয়েছিলাম সাধ্যমত। সবাই বলেছিল সুজিত খুব ভালো ছেলে এবং ছেলের মা-বাবাও। সুমিতার কোলে ছেলেকে কাঁদতে দেখে মনোরমা কোলে নিয়ে খাওয়ানোর জন্য সেরিলেক গোলাতে থাকে। মেয়ের কথা শুনে মনীশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বারান্দায়।
মনীশ দাম একসময় পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। এখন তিনি অবসর- প্রাপ্ত কর্মচারী, অত্যন্ত সাদাসিধে সরল মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে থাকেন না। নিজে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না তাই মনোরমার উপরেই নির্ভর করেন অনেকটা। মনোরমাও অত্যন্ত সহজ সরল মহিলা। তিনিও একসময় স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। এখন অবসরের পর সাংসারিক কাজকর্মে দিন কাটান। বহু কষ্ট করে একমাত্র সন্তান সুমিতাকে বড় করেছেন তারা। উচ্চশিক্ষা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত তৈরি করেছেন। তাই তিনি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন যে মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছু রোজগার করতে পারবে। পরনির্ভরশীল হয়ে জীবন কাটাতে হবে না তাকে কারণ তিনি জানেন, মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন মুক্তি নেই।"
তা সত্ত্বেও আজ সুমিতার দুরবস্থা দেখে তিনি মর্মাহত। "
"এখন কি করতে চাস?"মনোরমা মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেই মেয়ে বলে, আমি সহজে হাল ছাড়বো না মা। আমি এর শেষ দেখব। আমি এখানে থাকবো না,চলে যাব বিকেলে। আমি ওখানেই থাকবো ছেলেকে নিয়ে। ওকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবো। ওকে তো মানুষ করতে হবে। ও ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু আমি তো পারি না।"
বিকেলে চলে যায় সুমিতা শিলিগুড়িতে। মনিশ- মনোরমা নীরব। বিষন্ন মনে বসে আছে ঘরে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে মনোরমা বলে,"এখন বলতে বাধা নেই যে আমাদের গোড়াতেই ভুল হয়েছে। পুরো সিস্টেমটাকে পর্যালোচনা না করে ঐরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি আমাদের।"
মনোরোমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মনীষ বলে ওঠে, "হঠাৎ এই কথা কেন? কোথায় ভুল ছিল?"
"হঠাৎ কেন হবে। যবে থেকেই ওদের দাম্পত্যে ফাটলের কথা জানতে পেরেছি তবে থেকে এই চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে। তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
"হবে না কেন তোমার যা কষ্ট আমারও তা-ই।"
"কিন্তু এই কষ্টটা হতো না যদি না---"
"যদি না- মানে? "তীক্ষ্ণ স্বরে মনোরমা জিজ্ঞেস করতেই মনিশ বলে, যদি না বড্ড তাড়াহুড়ো করতে তাহলে হয়তো মেয়েটার জীবনে এমন সংকট তৈরি হতো না।"
"এখন তাড়াহুড়ো বলছো। তখন কই কিছু বলোনি তো?"
"বলিনি কারণ তোমার ইচ্ছে ছিল আমার থেকেও বেশি তাই। আমি খারাপ বলছি না কিন্তু আমাদের ভুলটা কোথায়,সেটা দেখো---
ওরা এক দেখাতেই পছন্দ করলো মেয়েকে। ওদের নাকি অনেক সম্বন্ধ এলেও আমাদের মেয়েকে ওদের ছেলের পছন্দ। "এ পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু আমরা প্রথম ভুল করলাম ওদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে। আমরা বলতেই পারতাম মেয়েকে এখন বিয়ে দিব না। আর একটু সময় নিতে পারতাম।
কিন্তু সেটা না করে আমরা দ্বিতীয় ভুল করলাম ওদের ছেলের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে।
"মানে?" মনোরমা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে। "মানে আর কি, ছেলের মেয়েকে পছন্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব। শুধু কি তাই বিয়ের ডেট নিয়ে তাড়াহুড়ো শুরু করল অথচ এই তাড়াহুড়োর কারণ খোঁজার চেষ্টা আমরা করলাম না বিন্দুমাত্র। ওদের তাড়াহুড়োকেই প্রাধান্য দিয়ে আমরাও শুরু করে দিলাম বিয়ের তোরজোর। তাড়াহুড়োর কাজের ফল ভালো হয় না, এটা আমরা সবাই জানি। অথচ নিজেদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টা একবারও ভাবলাম না। এখন যদি সত্যি কথাটা বলি তাহলে তুমি ফোঁস করে ফণা তুলবে।"
"শুনি তোমার সত্যি কথা।" —মনোরোমার তির্যক বাকভঙ্গিতে মনিশ একটু থেমে নরম সুরে বলে, "কি আর বলবো যদি সত্যিই শুনতে চাও তাহলে বলি, এ বিয়েতে আমার খুব একটা মত ছিল না। কিন্তু তুমি চেয়েছো বলে আমি তোমার সাথ দিয়েছি।"
"আমি তোমার সাথ দিয়েছি"মুখ ভেংচে মনোরমা বলে, "বাহ্ কি সুন্দর কথা! মনে হচ্ছে সব দায় আমার ছিল? আজ পর্যন্ত তুমি কোনো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করোনি। তাই আমি শুধু চেয়েছি একটা ভালো ছেলে যখন পাওয়া গেছে একই প্রফেশনের এবং কাছাকাছির তাই ভেবেছিলাম, দু বছর পরেও তো দিতে হবে, না হয় দু'বছর আগেই দিলাম। ব্যাস শুধু এটুকুই আমার চাওয়া ছিল কিন্তু তোমার যে মত ছিল না, তা তো তুমি আগে বলোনি। আসলে ব্যাপারটা কি বলতো মানুষ যখন কোনো কাজে ভালো ফল পায় তখন তার প্রশংসা কেউ করে না কিন্তু ফল খারাপ হলে তার দোষ খুঁজে বের করার জন্য খানাতল্লাশি চালায়।"
"আমি সেটা চাইনি বলে তোমার ইচ্ছেতে বাধা দিইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছো তো, তাড়াহুড়োর কাজের ফল ভালো হয় না।"
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনোরমা বলে,"হ্যাঁ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না যে, তাড়াহুড়োর দায় শুধু আমার উপরে পড়ছে কেন।
—"তুমি ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাড়াহুড়ো করেছো তাই।"
—তুমি তাড়াহুড়ো করতে দিলে কেন? নিষেধ করতে পারতে।"
—"নিষেধ করলে তো তোমার রাগ হত।"
—"রাগ হবে বলে তুমি ভুলটা শুধরে দেবে না? "তুমি নিজে কোনো বাড়তি কাজ করবে না আবার আমি করলেও তার দোষ ধরবে এটা কেমন আচরণ?
—"বাড়তি কোন্ কাজটা করতে পারতাম?"
—"কেন ভিতরের খবর নিতে পারতে না কোনো থার্ড পার্সেনকে দিয়ে?"
কথায় বলে, 'চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে', এখন একে অপরকে দোষারোপ করে কি লাভ। বরং ভাবতে হবে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়।"
"সমস্যার সমাধান আর কি হবে, মেয়েটার জীবনটা তো নষ্ট হয়েই গেল। এর জন্য আমিই দায়ী। মনোরমা ঠোঁটে বিষন্ন হাসি নিয়ে বলে, এক দেখাতেই যখন ওকে পছন্দ করলো ওরা তখন মনে হয়েছিল মেয়েটা সুখী হবে। বিশেষ করে ছেলের প্রফেশনের সঙ্গে মেয়ের প্রফেসর ম্যাচ করছে। ছেলে শিলিগুড়িতে থাকলেও বাড়ি এই শহরেই। তাছাড়া আচরণেও বিনয়ী ভদ্র। তাই সাধা লক্ষ্মী পায়ে না ঠেলে ওদের তাড়াহুড়ো মেনে নিতে দ্বিধা করিনি। যা-করেছি সব মেয়ের সুখের কথা ভেবেই।"
"তোমার ভাবনাতে কোনো দোষ নেই, দোষ হয়েছে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া।"
দেখলে তো, হঠকারিতার ফল ভালো হয় না।"
সন্ধ্যার আকাশে তাকিয়ে মনোরমা বিষন্ন কণ্ঠে অস্ফুটে বলে, হ্যাঁ ঠিকই বলেছো, হঠকারিতা আমি একাই করেছি। ওর দুর্ভাগ্যের জন্য আমিই দায়ী, হ্যাঁ আমিই দায়ী বলতে বলতে মনোরমা একাই এসে দাঁড়ায় অন্ধকারে।
No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.