বিদ্রোহ থেকে মানবতা: আজও প্রাসঙ্গিক কাজী নজরুল ইসলাম
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজও প্রাসঙ্গিক
শুধু বাংলার নন, সমগ্র ভারতের মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। বিদ্রোহী কবি হাবিলদার অবস্থায় কাব্য ও সাহিত্য রচনা হাত পাকান। ছোটবেলায় যোগ দিয়েছিলেন নাট্য দলে ও সৈন্যদলে কিন্তু সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল তীব্র। তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে শুরু করেন লেখা পত্রপত্রিকায়। তিনি পৌরুষদীপ্ত রুদ্র ভাবের কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসেন নতুনত্বের স্বাদ।
বাংলা সাহিত্যের কাব্যজগতে কবির আবির্ভাব ধুমকেতুর মতো। কবি ১৮৯৯ সালের ২৬শে মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র সাধারণ মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ফকির আহমেদ নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্যক্তি এবং মাতা দয়ার্দ্র চিত্ত জাহেদা খাতুন। দারিদ্রপূর্ণ পরিবারে কবির আবির্ভাবে দারিদ্রের অতিরিক্ত বোঝা গণ্য করে বাল্যকালে নাম রাখা হয়েছিল দুখু মিয়া। আট বছর বয়সেই পিতৃহারা হলে বাল্যকালে কবির ভাগ্যে পড়াশোনা তেমন জোটেনি তবে আরবি ফারসি এবং বাংলা ভাষা বেশ ভালোভাবেই শিখেছিলেন।
কিশোর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন লেটো গানের দলে।
পরবর্তীকালে তিনি ফরমায়েশি কবিতা গান লিখতেন তারপর প্রতিবেশীদের চেষ্টায় কবিকে রানীগঞ্জের সে আসল রাজ স্কুলে ভর্তি করানো হয় এবং মাত্র কয়েক মাস পরে মাস্রুম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় চলে যান এবং এখানেই কবি কুমির রঞ্জন মল্লিকের স্নেহদৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কবিকে।
এরপর স্কুল ছেড়ে তিনি এক রেলগাড়ির বাবুর্চির কাজ নেন এবং মাত্র এক টাকা মাস বেতনে রুটির দোকানে কাজ করেন সেখানে তিনি গান গেয়ে খদ্দের জোটাতেন এই সূত্রে তিনি একজন পুলিশ কর্মচারী সহায় তাই ময়মনসিংহ জেলায় গিয়ে অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে ওর বার সুযোগ পান এবং এখানেই তিনি রচনা লিখেছিলেন কবিতায় স্বাক্ষর রেখেছিলেন তার প্রতিভার কিন্তু অব্যবস্থা চিত্ত কবি দেশে ফিরে আবার লেটো দলে যোগ দিলেন।
আবার কবি ভর্তি হলেন কবি কুমুদ রঞ্জন এর স্কুলে এবং এখানেই তার শহীদ হলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। দশম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় একদিন ১৭ বছরের তরুণ কবি যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে বাঙালি পল্টনে তখন প্রথম মহাযুদ্ধ চলছে। এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে সৈনিক কবি দেশে ফিরে এলেন রণাঙ্গনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং তখন থেকেই তার মনে পরাধিনতার গ্লানি জনিত ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে দাবাগ্নি উঠল জ্বলে।
নারী স্বাধীনতার পক্ষে:
তিনি নারীর মুক্তি ও মর্যাদার কথা বলেছিলেন এমন সময়ে, যখন তা বলা ছিল বিপ্লবের শামিল।
- “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
- অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নারী অধিকার নিয়ে আজও যে সংগ্রাম চলছে, সেখানে নজরুলের ভাবনা অনুপ্রেরণা জোগায়।
পরাধীন ভারতবর্ষে বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে তার সাম্যবাদ, পরাধীনতার বাঁধন ভাঙ্গার তীব্র আকুতি, হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রভৃতি অগ্নিস্রাবী কবিতা ও গান রচনা করে বিদ্রোহী কবিরূপে যেমন খ্যাতি লাভ করেন তেমনি শাসক শক্তির কাছে শাসকের বিরোধিতা করার জন্য কারারুদ্ধ হন। অথচ এই বিদ্রোহী মানুষটিরও অন্তরে ছিল ভক্তিভাবের ফল্গুধারার অন্তঃসলীলা যার প্রকাশ শ্যামা সঙ্গীত ও ইসলামী গানে। অন্যদিকে ছিল প্রেমের অনবদ্য প্রকাশ। তাঁর কাব্যগুলি অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশি, প্রলয় শিখা, সর্বহারা, ফনিমনসা, নতুন চাঁদ,চক্রবাক প্রভৃতি।
সংগীত ও সাহিত্যিক বৈচিত্র্য
কবি নজরুলের গীতি গ্রন্থগুলি বুলবুল (২খণ্ড), বনগীতি, চোখের চাতক, নজরুল গীতিকা, গীতিমাল্য, রাঙা জবা, সন্ধ্যা মালতি, সুনির্বাচিত নজরুল গীতি, গীতিশতদল, গানের মালা, গুলবাগিচা, চন্দ্রবিন্দু প্রভৃতি।
অনুবাদ কাব্য- রুবাইয়াত-ই হাফিজ, কাব্যে আমপারা, রুবাইয়াত-ই-ওমর-খৈয়াম।
গল্প সংকলন- ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলি মালা।
পত্র উপন্যাস- বাঁধনহারা, এপিসটলারি নভেল।
উপন্যাস- কুহেলিকা, মৃত্যু ক্ষুধা,জীবনের জয়যাত্রা।
প্রবন্ধ- যুগবাণী রাজবন্দির জবানবন্দী রুদ্রমঙ্গল দুর্দিনের যাত্রী ধুমকেতু।
একটি নাটক সংকলন ঝিলিমিলি, সেতু বন্ধ ও শিল্পী।
গীতিনাট্য- আলেয়া (অপেরা)মধুমালা,দেবীস্তুতি গীতি আলেখ্য জাতীয় রচনা।
নাটিকা- বিদ্যাপতি, বিয়ে বাড়ি, শ্রীমন্ত, পুতুলের বিয়ে, ইদলফেতর, বনের বেদে, ভূতের ভয়, কালোয়াতী কস রৎ এবং প্রীতি উপহার।
- পত্র সাহিত্য- নজরুল পত্রাবলী
- ছায়াচিত্রের কাহিনী- সাপুড়ে বিদ্যাপতি
পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন নবযুগ, ধূমকেতু, নওরোজ। এ ছাড়া আরবি, তুর্কি, উর্দু,ওড়িয়া, ইংরেজি এবং রুশ ভাষাতেও কবি নজরুলের বহু কবিতা অনূদিত হয়েছে।
রবীন্দ্র কাব্যের গতি তত্ত্বের 'বলাকা' এবং 'রবির শেষ রাগিনীর বীণ' পূরবী কাব্য রচনার সময় কবি নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। তিনি রবীন্দ্রনাথের যেমন স্নেহধন্য তেমনি কবি ও সমালোচক কবি মোহিতলাল মজুমদারের শিষ্য ছিলেন। বিদেশি শাসকের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ বলিষ্ঠ ও সোচ্চার। তাই তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে বিদ্রোহাত্মক মনোভাব এবং প্রতিবাদী সুর। তাঁর এই প্রতিবাদের গুরুগম্ভীর বিদ্রোহী সত্তার তীব্র ধ্বনি ঝংকার ঝংকৃত হয়েছে তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতায়- "আমি বিদ্রোহী অথবা আমি চির বিদ্রোহী বীর।"
কবি মোহিতলাল তাঁর কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন যে তাঁর কবিতায় আধুনিক যুগমনের একটি বিশেষ প্রবৃত্তি অর্থাৎ প্রাচীন সমাজের জীর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর নানা সংস্কার ও নির্জীব আচারের বন্ধন ছিল ছিন্ন করার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা--- "তাহার-ই ভেরী রব অতিশয় দীপ্ত ও অধীর ছন্দে বাজিয়া উঠিয়াছে।"
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন গভীর মানবপ্রেমী। তাঁর পরাধীন ভারতবাসীর প্রতি ছিল সহানুভূতি ও গভীর মহত্ত্ব। নির্যাতিত শোষিত মানুষের পীড়ন তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল। তাঁর একদিকে সাম্যবাদ অন্যদিকে মানুষের প্রতি গভীর প্রেম তাঁর কাব্যের মূল সুর। তাই তিনি লিখেছেন, "এত অনাচার সহে যাও তুমি, তুমি মহা মহিয়ান।"
শুধু শাসকের পীড়ন শোষণ নয়, সমাজের সমাজকর্তা ও মৌলবাদী ধর্মধ্বজিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সমান বিদ্রোহী কিন্তু কখনো কখনো এই বিদ্রোহী মানুষটি ছিলেন ভাবুক প্রেমী ও সৌন্দর্য পিপাসু এক ভক্ত মনের স্রষ্টা। তাঁর এই মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে 'সংগীত সংকলনে।'
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন যৌবনের পূজারী ও তারুণ্যের প্রতীক। তাঁর এই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'জীবন বন্দনা','ছাত্রদলের গান' প্রভৃতি কবিতায়। তিনি যৌবনোদ্দীপ্ত শক্তির অধিকারী রূপে চিরতারুণ্যের প্রতীক রূপে গেয়েছেন ছাত্রদলের জয়গান।
বিদ্রোহী চেতনা ও সামাজিক প্রতিবাদ:
নজরুল ছিলেন “বিদ্রোহী কবি”। তিনি অন্যায়, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
- আজও দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মীয় উগ্রতা, নারী-পুরুষ বৈষম্য বিদ্যমান। নজরুলের লেখা—
- “আমি চির বিদ্রোহী বীর” —
- মানুষের প্রতিবাদী মনোভাব জাগাতে সাহায্য করে।
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী যুগের একমাত্র কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর ছিল যুগবৈশিষ্ট্যে স্বদেশপ্রেম এবং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে এক ঐক্যবোধের মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী মন। আর এই মানসিকতাকে প্রকাশ করার জন্য তিনি যে চিত্রকল্প রচনা, ছন্দ প্রয়োগ ও অলংকারের কারুকার্যের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অভিনব। তাঁর কবি স্বভাবের বৈশিষ্ট্যের সাথে কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের কবি রসেটি কিংবা সুইসবার্গের সঙ্গে।
কবি নজরুল ইসলামের কবি জীবন কোন সংকীর্ণ রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয় নি। তার ছিল সত্যের প্রতি অনুরাগ এবং মানুষের প্রতি অসীম দারুণ। নিপীড়িত মানুষের প্রতি মমত্ব প্রদর্শনী তিনি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর কবিতায় জাতি ধর্মের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে। বিধাতার সৃষ্ট জগতে তিনি দুর্বল অসহায় মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে অটল ছিলেন। তাই তাঁর কবিতায় দৈব নির্ভরতার পরিবর্তে আত্মশক্তির প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার। অসহায় কৃষক মজুরদের সংগঠিত করার জন্য তিনি কাব্যজগতের বাইরে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এইজন্য ব্রিটিশ সরকার এক বছরের জন্য তাঁকে কারা- গারে আবদ্ধ রেখেছিলেন।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান:
নজরুল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাম্যের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন—
- “মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।”
বর্তমান সময়ে যখন ধর্মীয় বিভাজন ক্রমবর্ধমান, তখন নজরুলের লেখা মানবতার সুর বয়ে আনে।
তিনি গায়ক, সংগীত রচয়িতা এবং সুরকার হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবির রচিত গানগুলি 'নজরুল গীতি' নামেই পরিচিত।
স্বাধীন ভারতের সরকার কবিকে 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'জগত্তারিণী' পদক প্রদানে সম্মানিত করেছিলেন। রবীন্দ্রভারতী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিলেন 'ডি.লিট উপাধি। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান তাঁকে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সরকারের সম্মান সূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন। অবশ্য বিধাতার নিষ্ঠুর অভিশাপে তিনি জীবনের শেষ দিনগুলি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বাক্ শক্তি রহিত অবস্থায় কাটান।
অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট তিনি বাংলাদেশে পরলোকগমন করেন। কবির দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাঁর সৃষ্টিতে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। যতদিন পৃথিবীতে দুঃখ-দারিদ্র, নিপিডন-নির্যাতন থাকবে, থাকবে সামাজিক বৈষম- অনাচার ততদিন তাঁর কবিতার আবেদন থাকবে।
তাই তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
Still Relevant: Poet Kazi Nazrul Islam- Khushi Sarkar
No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.