Pratiksha Short Story by Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

20 Sept 2025

Pratiksha Short Story by Khushi Sarkar

Pratiksha Short Story by Khushi Sarkar

Pratiksha short story by writer Khushi Sarkar

Khushi Sarkar wrote the short story Pratiksha

Waiting Mother—'Rani' also waits for her beloved in her heart.

প্রতীক্ষা

খুশী সরকার

প্রভাতবাবু ঘেমে নেয়ে মর্নিং ওয়াক করে বাড়ি এসে দেখে তন্দ্রা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। মনে মনে ভাবে, "ও তো আমার ওঠার পরে পরেই ঘুম থেকে উঠে যায় কিন্তু আজকে ওঠেনি কেন?" "কি গো উঠলে না যে" প্রভাতবাবু একরাশ আশঙ্কায় জিজ্ঞেস করে তন্দ্রাকে।

"উঠছি গো,আসলে শরীরটা আজ ভালো নেই, তা-ই আর কি— গলায় কষ্ট জড়িয়ে কথাগুলো বলেই তন্দ্রা বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চারদিক তাকিয়ে দেখে অনেকক্ষণ ধরে। 
"দাঁড়িয়ে রইলে যে" আবারও জিজ্ঞেস করে প্রভাতবাবু।

"জানো, আজকে মেয়েটার জন্য মনটা বড্ড খারাপ লাগছে, কেন যে বুঝতে পারছি না"।

"আরে, মায়ের মন তো—মেয়ে কাছে নেই, হয়তো তাই।

" ঠিক ধরেছো, মেয়েটা কবে গেছে! হয়তো সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছে। একবার ফোন করারও সময় পায় না বুঝি! উদাসী চোখে দূরে তাকিয়ে তন্দ্রা বলতেই প্রভাতবাবু বলে,বিয়ে দিলে মেয়ে তো শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে, তাই না?

"তা কি আর আমি জানি না" তন্দ্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তবুও— প্রভাতবাব‌ুও কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, "এইতো নিয়ম তন্দ্রা"!

— ঠিক সেই মুহুর্তে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই দরজার দিকে তাকিয়ে তন্দ্রা বলে, "যাও তো দরজাটা খুলে দাও, করুনার মা এলো বুঝি"।

— প্রভাত বাবু দরজা খুলতেই দেখে করুনার মা-ই এসেছে।

"আজকে একটু দেরী হয়ে গেলো গো, দাদাবাবু। আসছিলাম তো তাড়াতাড়িই, ওই যে মেয়েটা আমার বায়না ধরল, আজকে ওকে কোলে নিয়ে ঘোরাতে হবে। কি করবো বলো? ঘোরাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।

"তা বেশ করেছো, আমরা তো দুটি বয়স্ক প্রাণী, একটু পড়ে এলেও অসুবিধে নেই কিন্তু মেয়ের আবদার তো ফেলে দেয়া যায় না। যতটুকু পারো মেয়েটাকে সময় দিও" তন্দ্রার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে করুনার মা বলে, হ্যাঁ গো বৌদিমুনি, ঠিকই বলেছো কিন্তু কি করবো বলো? আমরা গরীব মানুষ, কাজ না করলে কি চলবে?

"তা তো বটেই, তবুও যতটুকু পারো মেয়েটার আবদার রেখো। আজকে পারছো না কিন্তু একদিন এই না পারার জন্য খুব কষ্ট পাবে। এই দেখো না আমাদের অবস্থা, মেয়েটার জন্য কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু কিছু করার নেই"!

করুণার মা প্রায় ঘন্টা দুয়েকে সমস্ত কাজ সেরে বেরিয়ে যাবার সময় তন্দ্রাকে বলে, বৌদিমুনি দরজাটা বন্ধ করে দিও, আমি আসছি গো"।

— "আচ্ছা ঠিক আছে" তুমি যাও।

দরজা বন্ধ করতে এসে তন্দ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রভাতবাবুকে ডাকে, ক‌ই গো, একবার বাইরে এসো, দেখো কে আসছে"?

— "এখন আবার কে আসবে?"

—"বাইরে এসে দেখোই না" তন্দ্রার উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বরে কৌতূহলী হয়ে বাইরে আসতেই প্রভাতবাবুর মুখটা ঝলমল করে ওঠে শরতের রোদের মতো। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে, দাদুভাইকে নিয়ে আমার মা এলো যে। দেখো দেখো তন্দ্রা, মেয়ের জন্য মন খারাপ করছিলে না, নাও এবার মেয়ে তোমার এসে গেল।" তন্দ্রাও আনন্দে হেসে বলে, "একেই বলে নাড়ীর টান,বুঝলে? বলেই এগিয়ে গিয়ে নাতিকে কোলে নেয় এবং মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছিস মা? জানিস, তোর জন্য আজ বড্ড মনটা খারাপ করছিল। এলি খুব ভালো লাগছে। বাড়িতে সবাই ভালো আছে তো মা?"

—"হ্যাঁ মা, সবাই ভালো আছে।" সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় 'রানী'।

"জামাই এলো না মা"? তন্দ্রা জিজ্ঞেস করতেই রানী বলে, "ও কয়েকদিনের জন্য কোম্পানির কাজে বাইরে গেছে। তাই চলে এলাম, ওই কয়েকদিন থাকবো বলে।"

—জামাই নিতে আসবে তো মা?"

হ্যাঁ হ্যাঁ ও এলেই নিয়ে যাবে। ও নিয়ে তুমি ভেবো না মা। সত্যি কথাটা বলে রানী বাবা-মা'কে বিব্রত করতে চায় না। সমু যেন কেমন বদলে যাচ্ছে, আজকাল তার সঙ্গে কিছুতেই মনের মিল হচ্ছে না একথা সে জানতে চায় না। তার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন সমু ঠিক আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে।

প্রভাতবাবুর খালি সংসার মেয়ে আসায় আবার ভরে যায় আগের মতো। হাসিখুশিতে উছলে ওঠে বাড়ি। একমাত্র মেয়েকে নিয়েই ছিল তাদের সুখের সংসার। প্রভাত বাবু তখন চাকরি করতেন পাশের গ্রাম্য শহর উত্তর দিনাজপুরের সদর শহর রায়গঞ্জের একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে। অত্যন্ত পরোপকারী উদার মানুষ তিনি। মেয়েকেও মানুষ করেছেন নিজের মতো কারণ তিনি জানেন মেয়ে হোক আর ছেলে হোক চরিত্রটাই মানুষের জীবন-ইমারতের মূলভিত্তি।

চরিত্রবল‌ই যে কাউকে সমস্ত বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে যেতে সাহস দেয়, যত বন্ধুর হোক তার জীবন-পথ, চরিত্রবলের সাহায্যে সেই পথকে মসৃণ করে তুলতে পারে। তিনি এও জানেন চরিত্র শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও সঠিকভাবে গড়তে হয় কারণ একটা সংসারে স্বামী-স্ত্রী দু'জন মানুষের। তাই দু'জন দু'জনার পরিপূরক না হলে একটি শান্তিময় সংসার গড়তে পারে না। অনেক ভেবেচিন্তে মেয়েকে যথার্থ মানুষ করে গড়েছেন প্রভাতবাবু। রানীও বাবার মত যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি ব্যবহারিক শিক্ষায় অত্যন্ত পারদর্শী। সাংসারিক শিক্ষাও পেয়েছে মায়ের কাছে। তাই অমন গুণবতী মেয়ের পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে।

ইতিমধ্যে প্রভাতবাবু চাকরি থেকে সুস্থ শরীরে অবসর নিয়েছেন তাই বেশি দেরি না করে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের যোগাযোগে ভালো কোম্পানিতে চাকুরিরতা সৌম্যজিৎ এর সঙ্গে একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন। খোঁজখবরে মানবিক গুণের পরিচয় জেনেছেন। অবশেষে উভয় পরিবারের সম্মতিতে ঘটা করে বিয়ে দিয়েছেন মেয়ের। বছরখানেক বাদে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান‌ও হয়েছে মেয়ের। মেয়ের ভাগ্যে খুব খুশি স্বামী-স্ত্রী।

রানীও সৌম্যজীতের সৌম্যকান্তি মূর্তি আর আদর্শমুখী চরিত্র দেখে খুব খুশি। মাস ছয়েক খুব আনন্দে ছিল রানী। বাড়িতে শাশুড়ি আর শ্বশুর মশাইও অত্যন্ত নিরীহ মানুষ। ঈশ্বরবিশ্বাসী রানী এই বিয়েটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই মনে করেছিল। বিয়ের প্রেগন্যান্ট এর এক মাসের মধ্যেই সৌম্য এবং তার শশুর-শাশুড়ি আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফোন আসে, তাকে বাঙ্গালোরে কোম্পানির ব্রাঞ্চ অফিসে কাজ করতে হবে।

অগত্যা রানীর ওই অবস্থাতেই বাবা-মা'র কাছে রেখে চলে যেতে চাইলে রানী স্বামীকে ছেড়ে থাকতে নারাজ। স্বামীর সঙ্গে যাবার জন্য বায়না ধরলে সমু আদর করে বলে, "শোনো লক্ষীটি, তোমার এই প্রেগনেন্ট অবস্থায় ওখানে একা থাকা ঠিক হবে না, আমি তো অফিসে যাবো, যদি কোনো অসুবিধা হয়— , আর এখানে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত কারণ মা-বাবা তোমাকে কত ভালোবাসে, তুমি তো জানো, তাই না?

—"তা তো বুঝলাম কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার যে ভালো লাগে না"— গলায় অভিমানের সুরে বলে রানী। "আমার‌ও কি ভালো লাগবে তোমাকে ছেড়ে, বলো? তবে ফোন তো আছে, আমি প্রত্যেক রাত্রে তোমাকে ফোন করবো, ভিডিও কল করবো, কেমন?

চাকরি তো করতেই হবে, তাই না? আমাদের ভাবী সন্তানকে উচ্চ শিক্ষা দিতে গেলে তো টাকাটা আগে দরকার। আর তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে, সমূর কথাগুলো শুনতে-শুনতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানী বলে। পরের দিন সমু চলে যায় বাঙালোরে। প্রথম প্রথম রানীর ভীষণ মন খারাপ করত তাই। মাঝেমধ্যে রানী বাবা-মা'র সঙ্গে দেখা করতে চলে আসে আবার কখনো কখনো শ্বশুর-শাশুড়িও সঙ্গে নিয়ে দেখা করিয়ে আনে। এভাবেই কেটে যায় সাত মাস।

রানী আসন্ন প্রসবা তখন। সমুর জন্য দিন গুনতে থাকে রানী কারণ ওই সময়টাই সমুকে সে তার পাশে চায়। হঠাৎ একদিন ঘোষণা হয় দেশজুড়ে লকডাউন হবে ২৩শে মার্চ থেকে। লকডাউনের কথা শুনে রানী তড়িঘড়ি সমুকে ফোন করে বাড়ি  চলে আসতে বলে। দেশে-বিদেশে কর্মরত চাকুরীজীবী এবং পরিযায়ী সবাই তখন ঘরে ফিরতে মরিয়া। সমুও কোনোমতে বাড়ি ফিরে আসে। শুরু হয় দেশজুড়ে লকডাউন।

পরের মাসে রানীর ডেট। সমু ফিরে আসাতে রানীর দুশ্চিন্তা দূর হয় কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই রানী সমুর মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে। আগের মতো আর সে আদর্শমুখী নয়। যে সমু সকালে উঠেই ঈশ্বরের নাম ধ্যান করতো সে এখন অনেক দেরীতে বিছানা ছাড়ে। একদিন রাতে রানী লক্ষ্য করে সমু মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে তার ব্যাগ থেকে কি যেন বের করে জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাচ্ছে। সে রাতে ভালোভাবে না জেনে কিছু বলেনি রানী। কিন্তু পরের রাতেও দেখে সে একইভাবে খাচ্ছে। আর একটা উগ্র গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে। সেই কটু গন্ধে ঘুমোতে পারছে না রানী। 

বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করবার পর একদিন জিজ্ঞেস করে,"প্রত্যেক রাতে তুমি কি খাও?"

"না না কিছু না, জল খাই, তেষ্টা পায় তো তাই"—সমুর কথায় রানী ঠিক বুঝতে পারে সে মিথ্যা কথা বলছে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে কি খাচ্ছে, তা তার বুঝতে আর বাকি থাকে না। মনে মনে ভাবে যে সমু কখনো মিথ্যা কথা বলত না সেই আজ অনায়াসেই মিথ্যে বলছে তাকে। শুধু কি তাই রোজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে যায় কোথায় এবং ফেরে অনেক রাতে অথচ দেশে লকডাউন চলছে।

— রানীর মনে প্রশ্ন জাগে, সে যায় কোথায়! সে বিষয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলেও বলে, "বন্ধুর সঙ্গে একটু আড্ডা মেরে আসি"।

কিন্তু সমুর অনুপস্থিতিতে তার মোবাইল ঘেঁটে রানী দেখেছে কোনো এক মেয়ের সঙ্গে তার কথা হয় রোজ কিন্তু মেয়েটি কে, কোথায় থাকে সে বিষয়ে তেমন কিছু জানতে পারেনি। সে বিষয়েও রাণীকে সমু কিছু জানায়নি। তাছাড়া সৌম্য আজকাল যেমন মিথ্যে কথা বলে তেমনি সহজেই রেগে যায় যা সমুর মধ্যে কিছুদিন আগেও দেখেনি রানী।

ধীরে ধীরে উভয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান শুরু হয়। আজকাল খুব একটা কথা বলে না রানীর সঙ্গে অথচ প্রত্যেক রাত্রে মদ খাওয়া চায় তার এবং আড্ডামারা, তাতে কোনো নড়চড় হয় না। এদিকে রানীর সময় প্রায়ই এগিয়ে আসে। নিজের শরীরের কথা ভেবে রানী আর তেমন বাড়াবাড়ি করে না কিন্তু মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার মেঘ ক্রমশই ঘনীভূত হতে থাকে।

একরাতে বাধ্য হয়েই রানী সমুর মদ খাওয়ার সময় সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ক্রুদ্ধস্বরে বলে, "এইভাবে মাঝরাতে রোজ রোজ বসে মদ খাচ্ছ, এটা কি কোনো ভদ্রলোকের কাজ? না, তোমার উচিত বলে মনে হচ্ছে"?

— "আরে ছাড়ো তো তোমার উচিত-অনুচিত, পুরুষ মানুষ একটু মদ খেলে কিছু হয় না" ক্রুদ্ধ সাপের মতো ফোঁস করে উঠে অত্যন্ত নিষ্ঠুর কথাগুলো বলে সমু।

— "তোমার তো এই অভ্যেস আগে ছিল না"।

— 'ছিল না', তাই বলে কি 'হতে নেই' তীর্যক ব্যাঙ্গের স্বরে রানী ভীষণ মর্মাহত হয়।

— তবুও আবার বলে, "তুমি কি সন্তানের সামনেও এই ভাবেই মদ খাবে"?

 

— "তাতে অসুবিধে কোথায়, এখন মদ অনেকেই খায়। তাদের সন্তান কি মানুষ হয় না"? সমুর এমন অরুচিকর মন্তব্যে রানীর ভীষণ কষ্ট হলেও নিজের কথা ভেবে আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

— দু-দিন পর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় রানীর। প্রথমে একটু একটু ব্যথা অনুভব হলেও পরের দিন রাতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয় এবং একটি ফুটফুটে ছেলের জন্ম দেয় সে। অবশ্য সব ব্যবস্থা সমুই করে। 

— রানী সুস্থ সন্তান নিয়ে তিন দিন পর ফিরে আসে বাড়িতে। কয়েকদিন থাকে অন্য একটি ঘরে, তারপর কয়েকদিনের জন্য চলে যায় বাপের বাড়ি কারণ শাশুড়ি বলেছে, এই সময় মেয়েদের আতুর কাটাতে বাপের বাড়ি যেতে হয় তাই শ্বাশুড়ীর কথামত কিছুদিন থাকে বাপের বাড়ি কিন্তু বাপের বাড়ি গেলেও রানীর মনে শান্তি নেই। সন্তান কোলে নিয়ে ভাবে,সমুর এই পরিবর্তন কেন? কি করে বদলে গেল সমু? রানীর অন্যমনস্কতা দেখে একদিন তার মা তন্দ্রাদেবী জিজ্ঞেস করে, "কি এত ভাবিস রে, মা?

— "না গো মা, তেমন কিছু নয়" রানীর সহজ উত্তরে মায়ের চিন্তা দূর হয়। কিন্তু রানীর মনে সেই একই চিন্তা। কিছুতেই সে তার চিন্তার কারণ মা'কে বলতে  চায় না কারণ সে জানে এমন কথা শুনলে তার মা-বাবা চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়বে তাই নিজের চিন্তা  নিজের মনেই গোপন রাখে।

— এদিকে প্রভাত বাবু ও তন্দ্রা ভাবে মেয়ের বোধহয় স্বামীর জন্য মন খারাপ করে। লাজুক প্রকৃতির মেয়ে রানী। তাই স্বামীর কাছে দিয়ে আসে। কিন্তু রানীকে কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে যেতে দেখে সমূ যেন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বিদ্রুপ করে বলে, "কি বাবা-মা রাখলো না বুঝি"?

— সমুর কথা রানীর আত্মমর্যাদায় ধাক্কা মারে। সহনশীল রানী শান্তস্বরে জানায়, "বাবা-মা'র কাছে সন্তান কি কখনো বোঝা হয়? তারা তো চায় আমাকে রাখতে কিন্তু আমি থাকলাম না তোমার জন্য"। 

— "কেন, আমার জন্য কেন? আমি কি ছোট বাচ্চা?"

— "তা কেন, আসলে আমারই তোমাকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগছিলো না, তাই"।

— "কিন্তু আমি তো তোমাকে ছেড়ে বেশ আছি"। সমুর এই সহজ কথায় রানী মনে কষ্ট পায় তাই ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গীতে বলে, "তা তো তুমি 'বেশ' থাকবেই কিন্তু আমি যে তোমাকে এই 'বেশ' ভাবে থাকতে দেবো না"।

— রানী লক্ষ্য করেছে সন্তানের প্রতি সমুর অসীম স্নেহ। যখন সুস্থ থাকে তখন বাচ্চাকে কোলে নিতে চায় সে কিন্তু রানীই তার কোলে দেয় না কারণ অতো ছোট বাচ্চা যদি সমু ঠিকমতো নিতে না পারে। আর এই স্নেহ দুর্বলতাকেই সে কাজে লাগাতে চায়। শুধু তাই নয় চোখের সামনে থাকলে হয়তো বাচ্চার কথা ভেবে মদ আর খাবে না কিন্তু শ্বশুরবাড়ী ফিরে দেখে উল্টো ছবি। আগে শুধু রাতে খেত এখন সে দিনেও খায়।

— পরের দিন অনেক রাতেও সমু না ফেরায় প্রচণ্ড চিন্তায় রানীর ঘুম আসছিল না। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ ঘুম জড়ানো গলায় সমুর ডাক শুনতে পায় রানী। দরজা খুলতেই দেখে সমুর পা টলছে এবং মুখে উগ্র গন্ধ। প্রচণ্ড রাগে দুঃখে ক্ষোভে চিৎকার করে বলে, "এত অধঃপতনে গেছো তুমি! যা রোজগার করো তার সব টাকায় কি মদের পেছনে ঢেলে দেবে, তাহলে সংসার চলবে কি করে?"  "বেশ করেছি, আমার টাকা আমি যা-খুশি করবো, তাতে তোমার কি? তোমার বাপ তো আর খাওয়াই না?"

 

— সমুর মুখে বাপ-মা সম্পর্কে এমন অশ্রদ্ধাপূর্ণ কথা শুনে শরীর রি রি করে জ্বলে ওঠে তার। অপমানে চোখ ফেটে জল আসে। মনে মনে ভাবে , এত সুন্দর ফুটফুটে সন্তান দেখেও তার আনন্দ হয় না? তাহলে—

রানীর দু'গাল বেয়ে শ্রাবণ ধারা বইতে থাকে। ওদিকে ঘুমন্ত একরত্তি ছেলে। সজল চক্ষে সন্তানের দিকে তাকিয়েই দেখে সমু টলতে টলতে সন্তানের পাশে গিয়ে শুতে চাইছে। মুহূর্তে বিদ্যুৎঝলকে আগুন জ্বলে ওঠে রানীর চোখে। সে আগুন যেন ভস্মিভূত করে দিতে চায় সমুকে। দ্রুতবেগে বিছানায় উঠে রানী ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় তাকে সন্তানের কাছ থেকে। প্রচণ্ড গর্জনে কামটের মত ঠোঁট চেপে চিৎকার করে বলে সমু, "এত বড় সাহস তোমার ছেলের কাছ থেকে সরিয়ে দাও আমাকে, বলতে বলতেই জোরে চড় বসিয়ে দেয় রানীর গালে।

সমুর এমন আচরনে বাকরুদ্ধ হয়ে কয়েক মিনিট থেকেই বাঘিনীর মতো ঘুমন্ত ছেলেকে দুই হাতে জাপটে ধরে শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বলে,"খবরদার, ওই মদ ধরা হাতে ছেলেকে ধরেছো তো! যতদিন না তুমি নিজেকে শুধরাচ্ছো ততদিন ছেলেকে স্পর্শ করবে না। ছেলেকে স্পর্শ করার অধিকার তুমি হারিয়েছো। আজ থেকে ছেলে আমার। আর আমরা আলাদা থাকবো"। তারপর একটু পরে শান্ত হয়ে বলে, "তবে হ্যাঁ ছেলেকে দেখা থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবো না, এই বাড়ীতেই থাকবো অন্য ঘরে আর যদি তাকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করো বা ধরার চেষ্টা করো তাহলে তখনই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব ছেলেকে নিয়ে, মনে রেখো।

শুধু এটুকু বলতে পারি, তোমার শোধরানোর জন্য আমি প্রতীক্ষা করবো। যেদিন তুমি নিজেকে শুধরে আবার সেই আমার আগের সৌম্যজিৎ হয়ে ফিরে আসবে সেদিন তুমি আমাকে আর তোমার ছেলেকে পাবে। রানীর কথাগুলো যেন সমুর মাথায় বজ্রাঘাতের মত ধাক্কা মারে। সমু বাড়াবাড়ি না করে শুয়ে থাকে ওইভাবেই বিছানায়। রানী তার সন্তানকে নিয়ে মেঝেতে মাদুর পেতে সে রাতের জন্য শুয়ে পড়ে কিন্তু কিছুতেই তার দু'চোখের পাতা এক হয় না। সমুর রুঢ় আচরণে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বিনিদ্র রজনী কাটায়।

পরদিন অতি ভোরে উঠে রানী পৃথক বিছানা তুলে বাইরে বারান্দায় এসে বসে সন্তানকে নিয়ে। মনে মনে ভাবে সমুর এই আচরণের কথা কিছুতেই সে জানাবে না তার শ্বশুর-শাশুড়ি বা বাবা-মা'কে। সন্তানের এমন আচরণের কথা বাবা-মা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই সহ্য করতে পারবেন না তাই নিজের গোপন ব্যথা নিজের বুকে চাপা দিয়ে সংসারে হাসিমুখে সন্তানকে নিয়ে কাটাতে থাকে আর আর প্রতীক্ষা করতে থাকে কবে সমু আবার আদর্শমুখী হয়ে ফিরে আসবে তার কাছে, সন্তানের কাছে হয়ে উঠবে আদর্শ পিতা।

— সমুর সঙ্গে তার তিক্ত সম্পর্কের কথা মুখে না বললেও শ্বশুর-শাশুড়ির বুঝতে অসুবিধে হয় না। শুধু এই ভেবে সান্তনা পাই যে তাদের এই আদর্শহীন চরিত্র ভ্রষ্ট ছেলেকে ছেড়ে না গিয়ে বৌমা সংসারেই থেকে গেছে তাই তারাও রানীকে কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে তার সঙ্গে সহজ-সাবলীল ব্যবহারে আনন্দে রাখে।

— রানীও সন্তান লালন-পালনের  সঙ্গে সমু এবং শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করে আর মনে মনে চলে তার শর্বরীর প্রতীক্ষা।

No comments:

Post a Comment

Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.