Prakriti Premik Sahityik Bibhutibhushan Bandyopadhyay by Khushi Sarkar
Essay - Prakriti Premik Sahityik Bibhutibhushan Bandyopadhyay
Author - Khushi Sarkar,
Poet Khushi Sarkar is writing the essay 'Nature Lover Literary Bibhutibhushan Bandyopadhyay'
'প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়' প্রবন্ধটি লিখেছেন খুশী সরকার।
প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
খুশী সরকার
'যখন যা পাস মিটায়ে নিয়ে আশ' এই সহজাত আনন্দবোধ ও সামান্যের মধ্যে অসামান্যের ঘনীভূত উপলব্ধির প্রকাশ জনপ্রিয় ভারতীয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন রচনায়। তাঁর রচনার একদিকে যেমন নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে এই বাংলার আম, জাম, জারুল বাঁশবন, কাশ-প্রান্তর ভাঁটফুল-পল্লব শোভিত শ্যামলা বাংলার অপরূপা প্রকৃতির নিরাভরণ সৌন্দর্য আর বাঁকে বাঁকে চলা ইছামতীর রূপকে এই বঙ্গের নদীতরঙ্গের আলোছায়ার খেলার স্নিগ্ধ প্রকাশ তেমনি অন্যদিকে আছে বিহারের রুক্ষ পটভূমিতে অরণ্য প্রকৃতির শাল মহুয়ার নির্জন ধূসরতা ও পাহাড়ী কাঁকড়- মাটির লালাভ রুক্ষতার এক বৈচিত্র্যময় চিত্রণ যেন অচ্ছেদ্য নাড়ীর যোগে এক আশ্চর্য সুন্দর নিসর্গপ্রকৃতির সার্থক প্রকাশ ঘটেছে 'পথের পাঁচালী'র চিরপথিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে। এই নিসর্গ প্রকৃতির সার্থক রূপকার হিসেবে তিনি অনন্য সাহিত্যশিল্পী।
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর এই বিরল বৈশিষ্ট্য সমন্বিত সাহিত্যিকের জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার হালিশহরের নিকটবর্তী মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার বনগ্রামে। পিতা মহানন্দ কথকতা ও পৌরহিত্য করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। দারিদ্র ছিল তার নিত্য সঙ্গী। শিশুকালে বিভূতিভূষণ শিক্ষারম্ভ করেন গ্রামের পাঠশালাতেই। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি পিতৃহীন হন। পরে বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯১৬ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ.পাশ করেন ডিস্টিঙ্কসহ।
কর্মজীবন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কর্মজীবন তিনি শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে এবং শেষও তাঁর এই শিক্ষকতা দিয়েই। এরই মাঝে তিনি কিছুকাল গোরক্ষিনী সভার ভ্রাম্যমান প্রচারক হয়ে বাংলা ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমন করেন।পরে খেলাৎচন্দ্র ঘোষের এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিছুদিন আবার ধর্মতলার খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। এখানেই আমৃত্যু কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্য জগতে বিভূতিভূষণের আবির্ভাব ১৯২৮ সালের মাঘ সংখ্যার প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত 'উপেক্ষিতা' নামে একটি ছোটগল্পের মধ্যে দিয়ে।
তাঁর প্রথম শুধু নয়, সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন মহত্তম সাহিত্য 'পথের পাঁচালী'- যার স্বাদ বিভূতিভূষণের আগে কোন কথাসাহিত্যিকের রচনায় পাওয়া যায়নি। এই অনাস্বাদিতপূর্ব 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের চিরকালের চেনা দরিদ্র গ্রাম, তার সহজ সরল মানুষের চরিত্র তাছাড়াও সেই চেনা পরিচিত ছবিকে ছাপিয়ে ওঠা গ্রাম্য প্রকৃতির এক সরল অকপট বর্ণনা কথাশিল্পীকে স্মরণীয় এবং বরনীয় করে রেখেছে আজও। মানুষের ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা হর্ষ-বিষাদ এবং অতি পরিচিত গ্রাম বাংলার খানা, ডোবা, আমবাগান, কাশবন, জলের উপর ভেসে বেড়ানো জল মাকড়সা, উড়ে বেড়ানো গাংচিল সামনের আমবাগানের মাথার উপর দিয়ে দূরের কোন নীল আকাশে চিলের চক্রাকারে ভাসমানতা- এসব ছবি যেন অপুর বিস্ময় মাখানো চোখে প্রকৃতির অপরূপ রূপ তুলে ধরেছেন প্রিয় কথা শিল্পী।
তাঁর এই অপরূপ চিত্রাঙ্কনে যে শব্দঝংকার ঝংকৃত হয়েছে তা যেন এক মায়াময় সুরের জগৎ। মধ্যাহ্নের খর সূর্যের প্রতাপ থেকে আলোছায়ায় নাচমহলের ঝাড় লন্ঠনের বিদ্যুৎময় আলোক ছটায় গ্রাম্য মৃন্ময় কুটিরের মৃন্ময় প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোকে এক বুদ্ধিদীপ্ত মননশীল বিশ্লেষণ থেকে এক অনুভূতিময় মর্মে উত্তরণ ঘটিয়েছেন।
পথের পাঁচালী গ্রন্থটি কে কবে রচনা করেছেন?
তাঁর 'পথের পাঁচালী'র হাত ধরে আমরা পৌঁছে যাই ফেলে আসা পল্লী কিশোরের আম, জাম, কাঁঠাল, বাঁশবন,কাশফুলের সেই স্বপ্নময় সুদূর অতীতে। আর যারা কোনদিনই গ্রাম দেখেনি, তাঁর কাছে সেই অনাস্বদিততপূর্ব সোনালী প্রকৃতি যেন মমতাময়ী মা রূপে উপস্থিত হয়েছে। এরপর তিনি যে অতুলনীয় সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন তা হল অপরাজিত, দৃষ্টি প্রদীপ, দেবযান, আরণ্যক, অনুবর্তন, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতি, অশনি সংকেত, বিপিনের সংসার কেদার রাজা ইত্যাদি উপন্যাস এবং মৌরিফুল, যাত্রা বদল, কিন্নর দল, মেঘমল্লার প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংগ্রহ। এগুলো বাদ দিলেও তিনি শুধুমাত্র 'পথের পাঁচালীর' জন্যই বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনার প্রভাব দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রকৃতির চেতনা তাঁর সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রকৃতিকে জীবিত সত্তারূপে অনুভব করেছেন কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর জন্মজন্মান্তরের বন্ধন অনুভব যেন রবীন্দ্রনাথকেই মনে করিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় তাঁর গল্পের অনেক নায়ক-নায়িকাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূক সুভার মতোই প্রকৃতির কোলে আশ্রিত, "প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়।"
এই প্রকৃতিচেতনা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন দিনলিপি, উপন্যাস এবং ছোটগল্পের অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে রয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই তাঁর গল্পসমগ্রের প্রথম খণ্ডে 'ছোটনাগপুরের জঙ্গলে' নামক রচনার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, "পৃথিবীর মাথার উপর আকাশ যেন নীল চাঁদোয়া খাটিয়ে দিয়েছে---- আকাশের গায়ে কি অপূর্ব নক্ষত্রশ্রেণী। মনে হচ্ছিল---- যেন আকাশে দেওয়ালীর দীপ জ্বলছে জ্বলজ্বল করে। অপূর্ব আনন্দ উপলব্ধি করেছিলুম। মনে হচ্ছিল, ভগবানের কি মহাশিল্প এই পৃথিবী।"
তবে তিনি শুধু প্রকৃতি চিত্র অঙ্কন করে ক্ষান্ত থাকেন নি, তার মধ্যে আধ্যাত্মিক চিন্তাকে কাঠামোরূপে বা মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে তিনি চিত্রিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে গল্পসংগ্রহের ভূমিকায় অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, "একমাত্র প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তিনি কখনো কোনো গল্প লেখেননি----- প্রকৃতি যখনই আবির্ভূত হয়েছে ছোটগল্পের রঙ্গমঞ্চে তখনই তার সঙ্গে এসে দেখা দিয়েছে মানুষ কিংবা মানুষের দেবতা।"
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের "বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে বিশ্বস্রষ্টার যোগসূত্রের ধারা তা তাঁর উত্তর কালে একাধিক কথাশিল্পীর মধ্যে শুধুমাত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই সার্থকভাবে অনুসরণ করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে প্রকৃতি প্রেমিক কবি বলা হয় কেন?
কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনা শুধুমাত্র অধ্যাত্ম- অনুভূতি সঞ্জাত নয়, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের অনুভূতির সঙ্গেও তার প্রকৃতিচেতনা একাত্ম। বিশেষত তাঁর প্রকৃতিচেতনায় ঈশ্বর অপেক্ষা মানুষের গুরুত্বই বেশি। প্রখ্যাত সমালোচক এবং ইংরেজি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ নীরদচন্দ্র চৌধুরী ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং হাডসনের সার্থক সমন্বয় দেখেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে। একদিকে তার যেমন প্রকৃতির রূপময় কান্তি আর তারই অন্তরালে অন্যদিকে নিগূঢ় প্রাণসত্তা। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকায় সম্ভবত এই কারণেই মন্তব্য করেছেন, "বিভূতিভূষণের উপন্যাসেও প্রকৃতি ও মানুষ এক সূত্রে গঠিত। তাহার সর্বজনপরিচিত অপু অর্ধেক মানব তুমি অর্ধেক প্রকৃতি।" কিন্তু এটি কেবল অপুর লক্ষণ নয়, বিভূতিভূষণের সমস্ত রচনারই সাধারণ লক্ষণ। অর্থাৎ বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসে এবং ছোটগল্পে একদিকে যেমন মানুষকে প্রকৃতির অংশবিশেষ হিসেবে দেখিয়েছেন অপরদিকে তেমনি তার সুখ-দুঃখ বা আনন্দ-বেদনা কেউ উপেক্ষা করেননি। যে প্রকৃতির লক্ষ্য কঠোর বা ভয়ংকর তার ক্রোড়ে লালিত মানব চরিত্রের মধ্যে রুক্ষতা বা কঠোরতার স্পর্শ লাগা স্বাভাবিক কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রকৃতি স্নিগ্ধ শান্ত এবং সুন্দর আর মানুষগুলিও তাই। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি মানব বর্জিত নয়, আদিবাসী, অরণ্যচারী শিশু, এরা প্রকৃতিলীন সত্তা। গ্রামীণ মানুষও প্রকৃতি- ঘনিষ্ঠ। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি যেমন সুন্দর ও মঙ্গলময়, তাঁর এই মানুষরাও তাই।"
প্রকৃতি প্রেমিক বিভূতিভূষণ সহজ মানুষের সহজ জীবনের রূপকার। তারাশঙ্করের মতো মানুষের আদিম বা অমার্জিত রূপ অঙ্কনে তিনি আগ্রহী ছিলেন না অন্যদিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষের মনের গোপন এবং জটিল অন্তঃপুরের রহস্যের চিত্র উদঘাটনেও তাঁর প্রবল অনীহা ছিল। তাঁর সহজ সরল আকর্ষণ তাই পদ্মা বা মেঘনা নয়, ইছামতী তাঁর প্রিয় নদী। মৃদুমন্দ কলরোলে এই নদীটি নিরবধি বয়ে চলে,--- 'তরঙ্গের ভঙ্গী নাই আবর্তের ঘূর্ণি নাই জলে'। এই ভঙ্গিহীন এবং আবর্তহীন নদীর দুই তীরের সাধারণ মানুষই তাঁর রচনার প্রধান উপজীব্য। "অপ্রকাশিত দিনলিপি"তে তিনি অকুণ্ঠচিত্তে এই মনোভাবের কথা দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন,"এক মুহূর্তে মনে হল কোথায় লাগে উড়িষ্যার পাল্লাহাড়া স্টেটের বনভূমি, কোথায় বা হিমালয়ের সৌন্দর্য। কুলে কুলে ভরা ইছামতী--- ঝোপে ঝোপে ভায়োলেট বনকলমি ফুল,--- এদিকে আবার বেতের ঝোপ ঘন সবুজ, সে এক অপূর্ব ব্যাপার। সে সৌন্দর্যের তুলনা হয় না.... মেঘের রং বদলে গেল-- নদী জল রাঙা হয়ে উঠেছে। ধারে ধারে ক্ষেতে সন্ধ্যায় ঝিঙেফুল ফুটেছে। কত শান্তি মনে এনে দেয়-- চারিধার নিস্তব্ধ, দূরে বহুদূরে পশ্চিম আকাশে শুকতারা উঠেছে: মনে হল আমার স্থান এই পাড়াগাঁয়ে। নদী তীরের ছোট্ট কুটিরে, কলকাতায় নয়, এদেরই কথা আমায় লিখতে হবে, এই ঝিঙ্গে ফুলের কথা-- এই সহজ জীবনের কথা। জার্মানি থেকে ধার করে আনা কমপ্লেক্স জীবন সমস্যা আমাদের দেশের নয়।"
অধ্যাপক জিতেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বিভূতিভূষণের গল্প সংগ্রহের ভূমিকায় একশ্রেণীর গল্প কে বলেছেন তার ঘরে ফেরার গল্প এই মন্তব্যটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ চরিত্রে রা তার স্রষ্টার মতোই নিজেদের দেশে বা নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরতে আগ্রহী। বিভূতিভূষণ যেমন দেশ ছেড়ে যখনি কোথাও গিয়েছেন তখন তাঁর মন পড়ে থাকত দেশের দিকে। তাই সুদূর নাগপুর শহরের ধারে পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখবার সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, "আজ দুর্গাপুজোর সপ্তমী। গোপালনগরে এখন পুজো হচ্ছে।বাঁওড়ের নালফুলের কথা মনে হোল।"
হয়তো এই কারণেই তাঁর 'দ্রবময়ীর কাশিবাস' গল্পের দ্রবঠাকরুণেরও কাশীতে তীর্থ করতে গিয়ে মুংলি গরু, ডুমুর গাছ আর খয়েরখাগি কাঁঠাল গাছের কথা মনে পড়ে গেছে। নাতি-কানুকে কাকুতি-মিনতি করে তিনি আবার দেশে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন---বলেন,কাশী পেরাপ্তিতে দরকার নেই,এই ভিটেই আমার গয়া কাশী।"
বিভূতিভূষণের সাহিত্যে অধ্যাত্মচেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তাই তাঁর 'ইছামতী' উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভবানী বাঁরুজ্যে এক জায়গায় বলেছে,' আমার মনে হয় ফুল, নদী, আকাশ, তারা, শিশু এরা বড় ধর্মগ্রন্থ।' আসলে এই চরিত্রের কথা স্রষ্টা বিভূতিভূষণেরই মনের কথা। প্রকৃতি এবং মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের কথা চিন্তা করা তাঁর কাছে সর্বদাই অর্থহীন বলে মনে হত। তাঁর আরাধ্য ঈশ্বরের মাহাত্ম্যের প্রকাশই ঘটেছে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং বৈচিত্রের মধ্যে, মানুষের স্নেহ, প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে। তাই অতি তুচ্ছ ও সাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও তাঁর ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ঘটে-- 'স্নান করতে যাওয়ার সময় মাকাললতার শোভা অপূর্ব--- ভগবানের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়। এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, কি সৌন্দর্যের আইডিয়া। বীজরূপী ব্রহ্মা এই অপূর্ব সৌন্দর্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন।"
শিল্পীর আরাধ্য ঈশ্বর তার চারপাশের অতি পরিচিত মানবজগৎ এবং প্রতি প্রকৃতি জগতে বিরাজমান। আবার কখনো কঠোর এবং কঠিন বাস্তবের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিভূতিভূষণের শিল্পীমানস রোমান্টিক অতীতের মধ্যে ক্ষণিকের আশ্রয় খুঁজেছে। এও এক ধরনের রোমান্টিকতা তবে এই ধরনের রোমান্টিকতা পলায়ন বাদ এরই নামান্তর রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যগ্রন্থের স্বপ্ন কবিতাটির মধ্যে এই জাতীয় কল্পনার স্ফুরণ ঘটেছে কিন্তু বিভূতিভূষণের রোমান্টিকতা কেবল বিশুদ্ধ সৌন্দর্য এবং অতীন্দ্রিয় প্রেমের প্রতি আকর্ষণের জন্যই নয়, কখনো নিছক ইতিহাস ভিত্তিতে আবিষ্ট হয়ে আবার কখনো প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের কোন বিশেষ কাহিনীর সাহায্য নিয়ে নিজস্ব জীবনদর্শন উপস্থাপিত করবার জন্য তিনি এই রোমান্টিকতার আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রকৃতি প্রীতির মধ্যেই কথা শিল্পীর অনন্য বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। এই বাংলার অতি সাধারণ আকড়ে সব ঝোপঝাড় বাঁশবন ভাত ফুলের মধ্যেও তিনি যেমন অপর আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছেন তেমনি বিশাল উন্মুক্ত অনন্ত প্রকৃতির মধ্যেও পেয়েছেন মহাজাগতিক রহস্যের সন্ধান প্রকৃতি প্রেমের হাত ধরে ঘটেছে তার মনে অসীম অনন্তের উপলব্ধি। অরণ্য প্রকৃতির উপরে নীরব জোৎস্না আর শব্দহীন রহস্যমাতা আমাদের মনে এনে দেয় এক অতীন্দ্র রহস্যানুভূতি।
এই অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ অত্যন্ত অল্প বয়সেই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের পহেলা নভেম্বর তাঁর অরণ্য পর্বতময় বাস্তব জগতের রূপলোক থেকে তাঁর 'দেবযানে' অমর অনন্তে যাত্রা করেছেন। এই বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী প্রকৃতির রূপকার বিভূতিভূষণের সীমাহীন স্নিগ্ধতায় উন্মুক্ত উদার যে অসীম অরণ্যের ধ্যানলোকে আমরা পৌঁছে যেতে পারি ধনী-দরিদ্রের ঘাত-প্রতিঘাতের দৈনন্দিন ক্লিন্নতা থেকে।এই ভাবেই হয়তো ফিরে পেতে পারি ক্ষণিকের জন্য আমাদের সহজ সরলতা, বিশ্বাস, প্রকৃতি, প্রেম এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা, প্রাণের আরাম আর মনের মুক্তি।
No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.