The short story Snehashish (Affection) is written by Author Khushi Sarkar.
'স্নেহাশীষ' ছোটগল্পটি লিখেছেন গল্পকার খুশী সরকার
স্নেহাশীষ
গল্পকার খুশী সরকার
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে তৃষ্ণার্ত দুপুর।খাঁ খাঁ করছে চারদিক। মানুষ পশু পাখি - একটুখানি ছায়ায় শীতল পরশ পেতে ব্যস্ত সবাই। মরুভূমি জীবনের শুষ্কতা নিয়ে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় নারিকেল পাতা থেকে কাঠি বের করছি। এমন সময় কানে এলো সাইকেলের বেলবাজার শব্দ। কান খাড়া করে আওয়াজটা বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হলো বাইরের দরজায়।
রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে মা বলল, "দেখ্ তো ঋতু, এখন আবার কে এলো?"
হ্যাঁ মা, দেখছি, বলেই দরজায় এসে আমার চক্ষু চড়কগাছ। "মামা তুমি?"
ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললাম, "ভেতরে এসো না?"
"নারে আজকে আর ভেতরে যাব না। তোর বাবার সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল তাই এলাম। তা তোর বাবা বাড়িতে নেই?"
"না, বাবা তো বাড়িতে নেই" মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম। অনেকদিন ধরেই আমার মনের কথাটা একবার মামাকে জানাবো ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু সুযোগ হয়নি তাই হঠাৎ মনে হল আজকে সেই কথাটা মামাকে বলেই দেখি, যদি কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আমার কথা শুনে সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখবেন এমন সময় পিছনের ক্যারিয়ারটা ধরে বললাম,
মামা তুমি তো রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ো, তাই না?
আমাকে ওখানে এগারো ক্লাসে ভর্তির একটা ব্যবস্থা করে দাও না। আমার পড়ার ভীষণ ইচ্ছে কিন্তু দেখো না, বাবা পাড়া-পড়শিদের কথায় আর পড়াতে চাইছে না। দেখো, এই দুই বছর ধরে ঘরে বসে আছি।
পড়ার জন্য মনটা ছটফট করছে অথচ পড়তে দেবে না।"
"একি! তোর বাবা একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও এরকম করলো। ঠিক আছে, আমার সঙ্গে দেখা হলেই আমি বুঝিয়ে বলবো, যাতে তোকে ভর্তি করিয়ে দেয়।" "একমাত্র তুমিই পারো মামা। আমি বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চায় না বরং বিয়ের ব্যবস্থা করছে। আমি কিছুতেই বিয়ে করতে চাই না। আমি পড়তে চাই, মামা। দয়া করে তুমি একটু বাবাকে বুঝিয়ে বলবে তো?"
"ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না। তোর বাবাকে বলে আমি নিজের দায়িত্বেই তোকে এবার ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব।" এখন আসি বলেই মামা চলে গেল। ততক্ষণে প্রখর রোদটা চলে গেছে। আকাশে তাকিয়ে দেখি, ভাসমান বাদল মেঘ সূর্যকে আড়াল করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই বৃষ্টিহীন তাপদগ্ধ মন অস্থির হয়ে উঠেছে আমার। মনের মধ্যে কল্পিত ছবিটা ভেসে উঠলো মুহূর্তেই। কি সুন্দর কলেজের পরিবেশ! বড়দের সঙ্গে আমরা ইলেভেন টুয়েলভ ক্লাসের পড়ুয়ারাও একই কলেজে পড়াশোনা করছি। পরিচিত বন্ধুরাও ভর্তি হয়েছে অনেকে এখানে। সবাই মিলে এক আনন্দমুখর পরিবেশ। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই চোখে জল এলো।
"কিরে, এতক্ষণ তোর কাঠি ছাড়ানো হয়নি? কি ভাবছিস অত?
"মায়ের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম। মুখটা ঘুরিয়ে চোখটা মুছে বললাম, হ্যাঁ মা হয়ে গেছে।"
"যা, এই গরমে না থেকে একটু ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।"
হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম কিন্তু কোনোমতেই চোখে ঘুম এলো না।
কেটে গেল বেশ কয়েকদিন। হঠাৎ আবার সেই সাইকেলের বেলের আওয়াজ। এক আকাশ আশা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি সেই মামা এসেছে কিন্তু আমি যাওয়ার আগে বাবা গিয়ে কথা বলছে তার সঙ্গে। হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দূরে। শুনতে পেলাম, বাবা বলছে, "এত করে বলছো যখন তাহলে তুমিই একটা ভর্তির ফর্ম নিয়ে ফিলাপ করে জমা দিয়ে দাও। এতই যখন ইচ্ছা ওর -----পড়ুক।"
মুহূর্তে শরীরে একটা ঢেউ খেলে গেল আনন্দে। সেই সময় মৃদু মন্দ বাতাস এসে বলল, আর ভাবনা নেই, এবার নতুন পথে যাত্রা হবে শুরু।
সেদিন রাতে বাবা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লো। মুখে বিষন্নতার ছাপ।
"কিগো এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লে যে?"মা জিজ্ঞেস করল।
"শরীরটা ভালো লাগছে না। নানান চিন্তায় মাথাটা ধরে আছে।"
"অত কিসের চিন্তা?"
"আরে প্রলয় দেখো না খুব করে ধরেছে ঋতুকে পড়ানোর জন্য। ও নাকি ওকে বলেছে ওর পড়ার খুব ইচ্ছে তাই ওকে বলেই দিলাম ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতে কিন্তু এখন ভাবছি শুধু ভর্তি করে দিলেই হবে? থাকার তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বাইরে থাকবে একা একটা মেয়ে। বুঝতে পারছো?
কখন কোন্ বিপদ হয়?
কে রক্ষা করবে ওকে?
এ তো ছেলে নয়, মেয়ে - কত সমস্যা হবে বুঝতে পারছো?"
"অত চিন্তা করো না।" মেয়ে আমার যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। সে নিজেকে রক্ষা করতে জানে। দাও দাও, এত যখন ওর পড়ার ইচ্ছে-
তারপরে পনেরো দিন প্রায় কেটে গেল। মামার আর পাত্তা নেই। শ্রাবনের বর্ষণ শুরু হয়েছে। পাড়ার চাষিদের মনে দারুন আনন্দ। আমন ধান রোপনের চেঁচামেচি শুরু হয়েছে অথচ আমার মনে কালবৈশাখীর ঝড়ে সব এলোমেলো।
মাস খানেক পর এলো সেই মামা। এবার বাড়ির ভিতরে গিয়ে বাবাকে বলল, "জামাইবাবু, আজকে ঋতুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আজকে ওর ভর্তির ডেট দিয়েছে।" আমি তো মামার কথা শুনে অবাক। মনে মনে ভাবছি,মামা কবে কি করল বুঝতে পারলাম না তো।"
"ও তাই, ঠিক আছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাও, তবে ও কিন্তু বাইরে তেমন যায়নি। একটু দেখেশুনে রাখিও। "বাবা সাবধান করে দিলো মামাকে।
কলেজের গেটে মামার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। দারোয়ান গেট খুলতেই আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকেই তো আমার চোখ ছানাবড়া। ওরেব্বাস, এত সুন্দর কলেজ! আমি এখানে পড়বো? আশা- আতঙ্কে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। যেন উচ্ছ্বাসের জোয়ার এলো মনে। চারিদিকে কত স্মার্ট ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে। গেটের নাক বরাবর একটি বড শ্রেণিকক্ষে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে একমনে ক্লাস করছে আর মাস্টারমশাই সামনে জলচৌকির উপর দাঁড়িয়ে লেকচার দিচ্ছেন। মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। আমি কলেজে পড়াশোনা করতে পারবো, সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাই মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম আমার শুভাকাঙ্ক্ষী সেই প্রলয় মামাকে, যার সঙ্গে আমার রক্তের বন্ধন নেই, কিন্তু গড়েউঠেছে গভীর স্নেহের এক আত্মিক সম্পর্ক। আজ সে উদ্যোগী না হলে এইরকম একটি অপূর্ব সুন্দর কলেজে ভর্তি হওয়া তো দূরস্ত,ঢোকার সুযোগই পেতাম না কোনোদিনও।
শুরু হলো আমার নতুন জীবন এক অজানা অচেনা পরিবেশে। প্রায় দশদিন যাতায়াত করলাম পাঁচমাইল পায়ে হেঁটে তারপর আধাঘন্টা বাসে গিয়ে। কিন্তু তাতে আমার যাতায়াত আর কলেজ করতে সারাদিন চলে যেত। দীর্ঘ পথ হাঁটার জন্য ক্লান্তিতে ঘুম এসে যেত প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাতেই, কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারতাম না। একদিন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই ভাবছি, এভাবে কি সম্ভব?
কিন্তু পরমুহূর্তেই 'বাড়ি ভাড়া'র কথা ভাবতেই আৎকে উঠলাম। তাই মনের কথা গোপন রইল মনেই। তবে একদিন আমার শারীরিক অবস্থা দেখে বাবা নিজেই বলল, "এভাবে পড়াশোনা কি হয়?" যদি পড়তেই হয় তাহলে বাড়ি একটা ভাড়া নিতেই হবে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "নিজেই রান্না করবি আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি, আমি এখানে সংসার বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব তোকে টাকা পাঠিয়ে দেব।"
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে উঠে এলাম ভাড়া বাড়িতে। ক্লাস করতে করতেই কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধু-বান্ধব হলো বেশ কয়েকজন। তার মধ্যে মিনা সেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল ঘনিষ্ঠ। ছয়মাস ক্লাস করার পর একটা বিষয় আমার উপলব্ধি হলো যে ইংরেজিতে আমার একজন টিউটরের দরকার কিন্তু এখানে বিশেষ পরিচিতি আমার কারো সঙ্গে নেই। তাই মনের কথাটা জানালাম মিনাকে। সে বলল ঠিক আছে, দেখি চেষ্টা করে তবে এখানে সাধারণত বছরের প্রথম থেকেই সবাই শিক্ষক নিয়ে নেয়।পরে আর পাওয়া যায় না।
তবু আমি তোর জন্য চেষ্টা করবো।
ওর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বললাম,
"হ্যাঁ একটু দেখ, যদি পারিস তাহলে খুব উপকার হয়।"
কিন্তু প্রায় মাসখানেক মিনা আর ক্লাসে আসে না। বড্ড চিন্তায় পড়লাম। অচেনা জায়গায় কারো সাথে তেমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। একদিন ঠিকানা খুঁজে ওর বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি ও অসুস্থ।
আমাকে দেখেই হতচকিত হয়ে বলল, "আরে তুই?"
বললাম, তোকে ক্লাসে দেখতে না পেয়ে ভীষণ খারাপ লাগছিল তাই চলে এলাম তোর সঙ্গে দেখা করতে।"
"খুব ভালো করেছিস। আমি তো মরমে মরে যাচ্ছি রে। হঠাৎ শরীরটা খারাপ হয়ে গেল। তুই যে দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছিলি সেটা তো করে উঠতে পারলাম না এখনো। তবে চিন্তা করিস না। কাউকে না কাউকে তো পাবোই। একজনের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে,একটু সুস্থ হলেই তোকে নিয়ে যাবো ওই শিক্ষকের কাছে। ভীষণ ভালো মানুষ উনি। আশা করি কাজটা হবে। দ্বিধান্বিত হাসি নিয়ে বললাম, "অত তাড়া নেই। তুই সুস্থ হ' আগে।এমনিতে তো চলেই গেছে অনেকদিন আর মাত্র তিনটা মাস বাকি। এই তিন মাস পেলেই হয়ে যাবে। তবে যদি উনি পড়াতে রাজি হন।
তিনদিন পর সন্ধ্যায় মিনা আমাকে নিয়ে গেল সেই মাস্টারমশায়ের কাছে তখন উনি স্কুল থেকে ফিরে রেস্ট নিচ্ছেন। এমন সময় আমরা হাজির উনার ঘরের দরজায়।
"স্যার আসবো?" মিনা অনুমতি চাইলো।
"কে" ঘর থেকে ভেসে এলো একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দ।
"আমি মিনা সেন, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই,স্যার।"
ও-ও মিনা? হ্যাঁ স্যার।
"আয় আয়, ভেতরে আয়।"
ভেতরে ঢুকেই দেখি এক শান্ত পরিবেশ। মৃদুস্বরে টেপরেকর্ডারে বাজছে অনুপ জালোটার ভজন 'মীরা কে প্রভু গিরিধারী--' আর সাদা ধবধবে পায়জামা ও সাদা সর্ট পাঞ্জাবি পরে একমনে গান শুনছেন তিনি।
"কেমন আছিস,মা ? মিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
"ভালো আছি স্যার।"
"কি বলবি, বল্"
"এ আমার বান্ধবী। ও আপনার কাছে পড়তে চায়।"আমাকে দেখিয়ে বলল মিনা।
"এখন!" বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
"স্যার, এখন এই তিন মাস যা' হবে ও সেটুকুই পড়বে।"
"তা এতদিন পড়েনি কেন?"
"স্যার, ও গ্রাম থেকে এখানে পড়তে এসেছে। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয় কিন্তু ওর পড়ার ভীষণ ইচ্ছে।"
"তা ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস, আগামীকাল একাদশ শ্রেণীর পড়ানোর ডেট আছে, সাতটা থেকে শুরু করি। তুই সাতটায় নিয়ে আসিস।"
ও একাই আসবে স্যার।
"একাই আসতে পারবি রে মা?"
এই আদুরে 'মা' ডাকে আমি মুগ্ধ হলাম। অজান্তেই আমার মাথা শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে যেন নেমে এলো তাঁর চরণে। কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। রাত্রে ভাবলাম অচেনা জায়গায় এমন দয়ালু আদর্শবান ব্যক্তির স্নেহ পাওয়া পরম ভাগ্যের ব্যাপার। মন বললো চোখ বুজে এমন মানুষকে বিশ্বাস ও ভরসা করা যায়।তাই আমার জীবনের কথা উনাকে জানাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সবার সামনে বলা সম্ভব নয়। হয়তো এতে অনেকে উপহাসও করতে পারে ভেবে আমি পরের দিন ঘন্টাখানেক আগেই পৌঁছে গেলাম স্যারের কাছে।
মিনার কাছে শুনেছি স্যার অত্যন্ত বিনয়ী এবং মিত ভাষী। সুদূর ২৪ পরগনা থেকে এই রায়গঞ্জের রামকৃষ্ণ বিদ্যাভবনে এসেছেন প্রধান শিক্ষক হয়ে। অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং দয়ালু মানুষ।
ঘরে ঢুকতেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এত আগে?"
"স্যার আপনাকে কিছু বলার আছে তাই একটু আগে আসলাম।"
"আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে বল্। তা তোর নাম যেন কি রে মা--"
আমার নাম ঋতু সরকার।
আসলে স্যার আমি মাধ্যমিক পাস করেছি দু বছর আগে কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশ বুঝতেই পারছেন আমার আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শী কেউ চায়নি আমি আবার পড়াশোনা করি। তাই বাবা সবার কথাতেই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন আর সে কারণেই আমার পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
অনেক জেদ করে এক দূর সম্পর্কীয় অথচ অত্যন্ত আত্মিক সম্পর্কের এক মামার সহায়তায় আমি এবার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হওয়ায় কোনো প্রাইভেট টিউটর নিতে পারিনি। ইংরেজিতে আমি একটু দুর্বল। তাই এই শেষ মুহূর্তে আপনি আমাকে যা শেখাবেন আমি আশা করি এতেই রেজাল্ট ভালো করতে পারবো।"
"বাহ্, তোর তো দেখছি আত্মবিশ্বাস খুব ভালো রে, মা।"
তাহলে শোন্ আমি তো এখন সাজেশন দিচ্ছি। সবকিছুই পড়ানো হয়ে গেছে তাই সাজেশনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি তুই যদি খুব ভালো করে প্রস্তুত করতে পারিস তাতেই তুই ভালো রেজাল্ট করতে পারবি। আমার পুরনো ছাত্রীদের কাছে আমার নোট আছে। তা তুই এখানে কোথায় থাকিস?"
"স্যার আমি দেবীনগর কালীবাড়িতে থাকি।
"বাহ্ বাহ্ তাহলে তো ভালোই হলো। ওখানেই চন্দনা ঘোষ নামে আমার এক ছাত্রী আছে। সেখানে তুই ওর সঙ্গে দেখা করে আমার কথা বলে ওর কাছ থেকে আমার নোটগুলো নিয়ে নিস। তোর উপকার হবে।"
"ঠিক আছে স্যার"
কিন্তু পরদিনই নোটের খোঁজে চন্দনার বাড়ি গেলাম। কিন্তু তার নোটগুলো কাকে যেন দিয়ে আর ফেরত পায়নি বলে সাফ জানিয়ে দিল।
অগত্যা স্যারের কাছে সপ্তাহে তিন দিন পড়তে গেলাম প্রায় দুই মাস। হঠাৎ একদিন পড়তে গিয়ে দেখি তিনি অসুস্থ। তবু অসুস্থ শরীর নিয়েই অস্ফুট কন্ঠে বললেন, "আমি হয়তো আর পড়াতে পারবো না। যা যা নোট সাজেশন দিয়েছি তোদের ওইগুলোই তোরা মন দিয়ে পড়্, তাহলেও ভালো রেজাল্ট হতে পারে।"
স্যারের কথা শুনে তো সবাই চলে গেল। শরীর খারাপ দেখে একাকী এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে উনার অসহায় অবস্থায় মনে যেমন কষ্ট হলো তেমনি আমার রেজাল্টের কথা ভেবে এক আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়লো সারা শরীরে। এই অবস্থায় ফিরে আসবো এমন সময় উনি আমাকে ডেকে বললেন, "তুই দাঁড়া।"
"কেন স্যার?" বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।
অতি ধীরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই তো কালিবাড়িতে থাকিস, না?"
আমি একটু ইতস্তত করে সম্মতি জানালাম।
"আমি তো ওদিকেই যাবো তাই তুই আমার সঙ্গে যেতে পারিস।" নিজেকে নগণ্য মনে করে বললাম, না,স্যার থাক, আমি পায়ে হেঁটেই যাবো। হঠাৎ বললাম, কালীবাড়িতে কোন্ ডাক্তার,স্যার?"
"ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার।"নামটা শুনে সেই বাড়ির ছবিটা মনে ভেসে উঠলো। হেসে বললাম, "ও তাই" আমি ওই ডাক্তারের বাড়ির পাশেই তো থাকি স্যার।"
"সেই জন্যই তো বলছি, তুই আমার সঙ্গে চল্।বাপ-বেটিতে এক রিক্সায় যাই।"
"এত আন্তরিক কথায় আর 'না' বলতে পারলাম না।
"তুই নিচে গিয়ে দাঁড়া, মা। আমি আসছি।"
আমি নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে উনি নেমে এলেন সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে। উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁর সেই ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ছবিটি দেখে আমার তৎক্ষণাৎ সেই শান্ত ভদ্র পোশাকে যেন এক দিব্য পুরুষ হেঁটে আসছেন আমার দিকে, মনে হলো। নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল সে সময়।
বড় রাস্তায় উঠেই একটি রিক্সাকে ডাক দিলেন। তিনি অতি ধীরে রিক্সায় উঠলেন এবং আমিও উঠে বসলাম পাশে। প্রথমে বুঝতে একটু ইতস্তত হলেও পরে মনে হল, এ তো আমার সৌভাগ্য, এমন একজন মহৎ প্রধান শিক্ষকের সান্নিধ্য পেলাম। উনি রিক্সায় আসতে আসতে আমার বাড়ি, বাবা-মা সবার কথা শুনলেন অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে এবং আন্তরিকভাবে।
কিছুক্ষণ পর আবার বললেন, "দেখ রে মা, গ্রাম থেকে এসেছিস শহরে পড়তে। মনে রাখিস, সব জায়গাতেই ভালো মন্দ আছে। তবে সেই ভালো-মন্দের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকেই নিজের রক্ষা করতে হয়। কেউ কি আর কাউকে রক্ষা করতে পারে রে মা? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন। আরো বললেন, "নিজেকে রক্ষা করতে শিখতে হয়। আর এ কয়দিনে তোর মধ্যে যে দৃঢ় মনোবল এবং উদ্যম দেখেছি তাতে আমি নিশ্চিত, তুই পারবি। তোর জয় হবেই।" হয়তো আমি আর পড়াতে পারবো না তবে তোর কথা আমার মনে থাকবে। আমি যদি রায়গঞ্জে থাকি আর কোনো অসুবিধায় পড়িস তাহলে আমাকে জানাস। বলতে বলতেই ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসে রিক্সা থামল।
স্যার নামলেন, আমিও নামলাম। মনের মধ্যে যেন এক পরম শান্তি অনুভব করে প্রণাম করতে গেলাম অমনি উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, "মা রে ভালো থাকিস, মন দিয়ে পড়াশুনা করিস।" এক নির্মল স্নেহ সিক্ত বারিবিন্দু যেন ঝরে পড়লো আমার মাথায়।
এমন পুণ্য স্নেহাশীষ আমি পাইনি কখনো। আবেগে কণ্ঠ বুজে এলো আমার। দু'গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু।
উনি ডাক্তারের চেম্বারে ধীরে ধীরে ঢুকে গেলেন, আমি পিছন ফিরতেই কানে ভেসে এলো - "তবু মনে রেখো,যদি দূরে যাই চলি-"
রচনাকাল - ২৪/০৭/২০২২
No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.