Byatikrami Byaktitwa Short Story by Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

2 Aug 2022

Byatikrami Byaktitwa Short Story by Khushi Sarkar

Byatikrami Byaktitwa Short Story Written by Khushi Sarkar

The short story Byatikrami Byaktitwa (Exceptional Personality) : Mizanur Rahman Sardar is written by author Khushi Sarkar. ব্যাতিক্রমী ব্যক্তিত্ব : মিজানুর রহমান সর্দার ছোটগল্পটি লিখেছেন গল্পকার খুশী সরকার।

ব্যাতিক্রমী ব্যক্তিত্ব : মিজানুর রহমান সর্দার
গল্পকার - খুশী সরকার

আজকাল দিনগুলো হাঁটছে হাতির পায়ে। ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভাঙো ভাঙো। নির্ঘুম কাটে বেশিরভাগ রাত তবে হ্যাঁ আজ ভোরবেলা হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। চোখ রগরাতে রগরাতে হঠাৎ নজরে পড়ল বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটায়। আহা,কি অপরূপ সেজেছে ফুলে ফুলে গাছটা। এক জায়গায় অনেক ফুলের মাঝে দেখি দুটো শালিখ বসে আছে পাশাপাশি। কেমন যেন একটা আনন্দের হিল্লোল তুলে গেলো অঙ্গে।
ছোটোবেলায় শুনেছি,ঘুম থেকে উঠে দুটো শালিখ দেখা নাকি শুভ। আপন মনেই হেসে উঠলাম, আমি আর শুভ? এ দুটোর মিলন, তাও আবার আমার জীবনে! অন্তত এতদিনে আমার জীবনে তো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে দেখিনি। পরক্ষণেই ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেল মনটা। কেন যেন মনে হল, হ্যাঁ হতেও তো পারে। তার জন্য‌ই তো চাতক চাওয়ায় বসে আছি। তবে আমি জানি, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।

তাই এই ভাবনাটাকে মনের কুঠুরিতে বন্দী করে রেখে মুখ ধুয়ে চা খেলাম। মন বলল,ওই সব শুভ-টুভ বড়লোকদের জন্য। তাই নিয়ম মাফিক অন্যান্য দিনের মতো টিউশনি করতেও গেলাম। বেলা দেড়টা নাগাদ ফিরেই দেখি পোস্টম্যান বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজাচ্ছে। "কোনো চিঠি-টিথি আছে নাকি?" জিজ্ঞেস করতেই উনি একটি রেজিস্টার খাম আমার হাতে ধরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় স‌ই করতে বললেন। হঠাৎ একটা পুলক অনুভব করলাম। শিহরিত হলো শরীর। খাম খুলতে দেখি ভেতরে একটা জয়েনিং লেটার। আবেগে হাত উঁচুতে তুলে,"ইউরেকা" বলে চিৎকার করতে করতে মায়ের কাছে গেলাম রান্না ঘরে। বললাম, দেখো দেখো মা, এই যে আমার জয়নিং লেটার। "উফ্" বলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আপনা-আপনি।

অবশেষে চাতক চাওয়া শেষ হলো আমার। আগামীকালই জয়েনিং ডেট। পরের দিন তড়িঘড়ি স্নান সেরে সামান্য একটু ভাত মুখে দিয়ে গাড়ি ধরার জন্য ছুটলাম। যেতে যেতে ভাবছি, শুনেছি প্রধান শিক্ষক ভারি রাগী প্রকৃতির মানুষ। একটু দেরি হলেই দারুণ কথা শোনান। আমার যদি দেরি হয়ে যায়! ভেবেই আঁৎকে উঠে শঙ্কিত হলাম, ঠিকমতো এখন পৌঁছাতে পারলে হয়! এই সব ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টার রাস্তা কখন পেরিয়ে পৌঁছলাম স্কুলের সামনে, বুঝতে পারিনি। কণ্ডাক্টার ডেকে দেওয়াতে হুঁস হলো।

সেই গত চার মাস আগে এসেছিলাম ইন্টারভিউ দিতে, তখন স্কুলটাকে সুন্দর মনে হলেও তাজমহলের মত ঝকঝকে এত সৌন্দর্য্য সেদিন মনে হয়নি। আজকে যেন আপন মনেই বলে উঠলাম, "বাঃ"! আনন্দে গদ গদ হয়ে হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকলাম। নমস্কার জানিয়ে দাঁড়ালাম উনার সামনে এই প্রথমবার। দেখেই আমার চোখ ছানাবড়া। ওরে বাবা! কি বিশাল লম্বা! একটা গাম্ভীর্যের চাদর যেন গায়ে। চোখ দুটো ঠিক যেন অথৈ সমুদ্র। জানলা গলে রবির কিরণে ঠিকরে বেরুচ্ছে ব্যক্তিত্বের ঝলমলে জ্যোতি। সামনাসামনি চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হলো না। জানলার দিকে চেয়ে দেখি আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।
"বসুন, দাঁড়িয়ে কেন?" গম্ভীর স্বরে বলতেই চকিতে চেয়ে বললাম, "হ্যাঁ ঠিক আছে।"

"তা আজকে আপনার চাকরির প্রথম দিন" টিচার অ্যাটেনডেন্স খাতায় সিগনেচার করবেন। আর কতগুলো প্রয়োজনীয় কথা বলে দিই। আপনিও যেহেতু এই পরিবারের একজন সদস্য হলেন তাই এই বিদ্যালয়ের কিছু নিয়ম-নীতি আপনার জানা দরকার।

প্রতিদিন প্রেয়ারের আগে মানে দশটা চল্লিশ এর মধ্যে বিদ্যালয়ে ঢুকতে হবে এবং স্কুল ছুটি হওয়ার আগে যাওয়া যাবে না। সি.এল নিতে হলে দরখাস্ত লিখে আগেই জানাতে হবে। অবশ্যই জরুরী অবস্থা হলে অন্তত ফোন করে জানাবেন। এই বিদ্যালয়ে আমরা যারা আছি, সবাই মিলে একটা পরিবার আমি মনে করি। সুতরাং সেই পরিবারের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব কিন্তু আপনার‌ও।
আমাদের এখানে কালচারাল দিকটা একটু দুর্বল তাই আমি চাই,এই দায়িত্বটা আপনি নিন।" একভাবে কথাগুলো পর পর শুনে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেদিনের কথা। ইন্টারভিউ হওয়ার দু মাসেও যখন কোনো খবর পেলাম না তখন অধৈর্য হয়ে গেছিলাম এই মাস্টারমশাই এর বাড়ি কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেদিন উনি শিলিগুড়ি গেছিলেন তাই বাধ্য হয়ে যখন ফিরে আসবার জন্য গাড়ির আশায় দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে এগিয়ে এলেন একজন ব্যক্তি। তখনো নাম কিংবা পরিচয় কিছুই জানি না তার। উপযাজক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় এসেছিলেন?"
বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে একবার আপাদমস্ত দেখে নিয়ে বললাম, আপনাকে তো ঠিক--
"হ্যাঁ, না চেনারই কথা, তবে আপনি যার সঙ্গে এবং যে কারণে দেখা করতে এসেছিলেন সে বিষয়টা মোটামুটি জানি।"
"আপনার নামটা যদি একবার বলেন"--

"অবশ্যই, অবশ্যই। আসলে আপনি আলোকতীর্থ বিদ্যাপীঠের বাংলা পোষ্টের জন্য যেদিন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম ওই স্কুলেই। তাই শুধু আপনি নয় প্রত্যেকেরই পরিচয় মোটামুটি সেখানেই জেনে গিয়েছিলাম।"
"তার মানে আপনি ওই স্কুলের শিক্ষক" দ্বিধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করতেই উনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মাথা দুদিকে দুলিয়ে সম্মতি জানালেন। এবং সেই সঙ্গেই জানতে চাইলেন, "আপনি রায়গঞ্জ থেকে এসেছেন তো?"
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
"চাকরির ব্যাপারে এসেছিলেন তো?"

প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান সরদারের কাছে? তাতেও মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ উত্তর দিলাম। বেশ হাসি খুশি এবং আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে একটু সাহসী হয়েই বললাম, "আপনি যদি একটু সাহায্য করেন?"

"কেমন সাহায্য চান বলুন? "মুহূর্তেই একগাল হেসে জানতে চাইলেন উনি।

একটু দ্বিধান্বিত হলেও প্রয়োজন ভেবে বললাম "শুনেছি, প্রধান শিক্ষক নাকি খুব রাগী লোক?"
"এই কথাটা শুনেছেন, আর কিছু শোনেননি?"

"না, তেমন কিছু শুনিনি।"

"তবে শুনুন। উনার বাইরেটা ভীষণ কঠিন হলেও মনটা অত্যন্ত নরম। অত্যন্ত পাংচুয়াল এবং সাত্ত্বিক মানুষ। ন্যায় ছাড়া অন্যায় কখনো করেন না। একার মতে কোনো কাজও করেন না, সবার মত নিয়েই করেন। এমনকি যদি কখনো কাউকে কথা দেন কোন বিষয়ে, সেই কথা উনি রাখেন যে কোন প্রকারে।"
"তাহলে তো একটা বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য একজন পারফেক্ট মানুষ তিনি, অন্তত আমার মতে।" আর একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে যদি বলেন"--

"বলুন না।"

এই পোস্টটার জন্য কি কেউ মনোনীত আছেন?"
একটু চিন্তা করে বললেন, "না, তেমনটা মনে হয় না। উনি যে প্রকৃতির মানুষ তাতে মনোনীত ব্যক্তিকে নেবেন এটা আমার মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, যোগ্যতার বিচারে এবং সবার মতে যিনি যোগ্য তাকেই নেবেন এটুকু জানি।"
এমন সময় গাড়ি এসে যাওয়াই আমি চলে আসি।

আজ মনে হচ্ছে উনি একটুও মিথ্যে বলেননি।

এই প্রথম দিন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চাকরিতে জয়েন করে যেমন আনন্দ হচ্ছে ঠিক তেমনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যাতে কোনোভাবেই উনি আমার প্রতি রুষ্ট না হন। তবুও বর্ষার আকাশে যেমন মেঘ জমে আবার প্রখর রৌদ্র তাপে তা সরেও যায় ঠিক তেমনি এগিয়ে চলল আমার চাকুরী জীবন। হঠাৎ একদিন ক্লাস নিচ্ছি এমন সময় ক্লাসে অনুমতি নিয়ে মোস্তাক মানে আমাদের সকলের প্রিয় নন টিচিং স্টাফ ঢুকে বলল,দিদিমণি, প্রধান শিক্ষক আপনাকে ডাকছেন।"
"ঠিক আছে,তুমি যাও। আমি আসছি।" বলেই ওর পিছু পিছু আসলাম।
প্রথমে একটু ভয় পেলাম কিন্তু পরে ভাবলাম আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, ভয় পাবার কিছু নেই। তাই প্রধান শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার আমাকে ডেকেছেন?" উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে একটা কি যেন কাগজ পড়েই চলেছেন।একটা গুমট ভাব অনুভব করলাম। মনে হলো আকাশে মেঘ জমেছে। পাশে চেয়ে দেখি উনার সামনে অন্য দুটি চেয়ারে বসে আছেন দু'জন ব্যক্তি।

"আপনি ক্লাস এইটের শ্রেণী শিক্ষিকা?" কিছুক্ষন পর বাক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন আমায়।
একটু ইতস্তত হয়ে বললাম, "হ্যাঁ।"
"মার্কসিটটা দিন তো আমাকে" বলেই তাকালেন সেই ব্যক্তিদের দিকে।" অমনি একজন ব্যক্তির হাতে মোড়ানো একটি কাগজ প্রধান শিক্ষক সামনে মেলে ধরে আমাকে বললেন, "দেখুন তো, এটা কি আপনার সিগনেচার?"
"হ্যাঁ" ভালো করে দেখে বললাম।
সঙ্গে সঙ্গে বাক্রুদ্ধ সিংহের মতো গর্জন করে বললেন, "আপনি কি চাকরি করতে এসেছেন, নাকি খেলতে এসেছেন?" যদি ঠিকমত চাকরি করতে পারেন তো করেন, না হলে ছেড়ে দেন। কথাগুলো যেন তিরের মত আঘাত করলো আমাকে। অপমানে লজ্জায় ভয়ে ছটফট করতে করতে বললাম,"কেন কি হয়েছে?"
"নিজে দেখুন কি হয়েছে?" কম্পিত হাতে মার্কশিট দেখতে গিয়ে দেখি, রেজাল্ট সিটের নম্বর তুলতে গিয়ে ওভার লুকিং হয়েছে। এক ঘরের সংখ্যার সঙ্গে অন্য ঘরের সংখ্যা যোগ হয়েছে। সেই মুহূর্তে কান দিয়ে আমার গরম হাওয়া বের হচ্ছে আর লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছি।
কাচুমাচু হয়ে বললাম ,"স্যার ভুল হয়েছে" ঠিক আছে, আমি নতুন মার্কসিট তৈরি করে দিচ্ছি।

"যান, এক্ষুনি নতুন মার্কসিট তৈরি করে দিন।"

তারপর অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে নতুন মার্কসিট তৈরি করে দিলাম ঠিকই কিন্তু সেদিন আমার চোখে জল আর বাঁধ মানেনি। উদাসীন ভাবে বসে আছি বাইরে চেয়ে। জল ঝরছে দু'গাল বেয়ে। অন্যান্য মাস্টারমশাইরা আমার বিমর্ষতার কারণ জানতে চাইলেও উত্তর দেয়ার মত মানসিকতা আমার ছিল না। এমন সময় হঠাৎ দেখি প্রধান শিক্ষক আমার পাশে এসে বসলেন আলতোভাবে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "খুব কষ্ট পেয়েছো না?"
তোমার মত কষ্ট তো আমিও পেয়েছি বলো?
আমার শিক্ষকদের কেউ অপমান করলে আমার কষ্ট হয় না বুঝি? হঠাৎ যেন কথাটা আমাকে জাগিয়ে দিল। ব্যথিত হৃদয়েও উপলব্ধি করলাম,এমন গাম্ভীর্যের সঙ্গে দয়া স্নেহ এবং প্রীতি কোনো মহৎ হৃদয়েই থাকা সম্ভব।তাই কিছুটা হলেও গর্বিত হয়েই কান্না ভেজা স্বরে বললাম, "সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার।এরপর যাতে আর ভুল না হয় সেই চেষ্টা করব স্যার।"

"তা তুমি করবে আমি জানি তবুও বলি--- মার্কশিট যখন তৈরি করবে, মনে রাখবে সেটা কিন্তু তোমার কাছ থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে সুতরাং ভুল হলেও তোমার আর কিছু করার থাকবে না তাই বারবার চেক করে তবেই ছাত্রদের হাতে দেবে,কেমন?"
মাথা নেড়ে সমর্থন করলাম আর অনুভব করলাম সত্যিই উনি আর পাঁচজন প্রধান শিক্ষকের থেকে আলাদা। শাসনের সঙ্গে ভালোবাসা মিশে যেন পূর্ণ শশী। নিশির আঁধার মুছে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না ঢালে অকৃপণ হাতে ধরার বুকে। প্রকৃতিও সেই মনোরম আলোয় হয়ে ওঠে অপরূপ সুন্দর।

তারপর আর কোনোদিন কোনো মার্কশিট কিংবা অন্য কোনো কাজে ভুল হয়নি আমার। উনি আপন আচরণে শিখিয়েছেন কিভাবে কাজে যত্নশীল হওয়া যায়। শুধু তাই নয়,কর্তব্যসচেতন হয়েছি সেই মহৎ ব্যক্তির কর্তব্যপরায়নতা দেখেই।প্রতিটি কাজ‌ই সমান মূল্যে বিবেচিত হয়।সবদিকে প্রধান শিক্ষকের ছিল সমান দৃষ্টি। এককথায় নতুন জীবন দিয়েছেন আমায়।

রোজ‌ই দেখতাম তিনি দশটার মধ্যেই বিদ্যালয়ে ঢুকছেন আর সবার পরেই স্কুল ছাড়ছেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা--- সবাইকে যেমন শাসন করছেন ঠিক তেমনটাই আবার ভালোবাসছেন। একটা পরিবারের মাথা হিসেবে যতটা দায়িত্ববান হওয়া উচিত উনি আমার চোখে তার থেকেও বেশি। সবথেকে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে আমার, শাসনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভালোবাসার পাল্লাটাও সমান। বরঞ্চ একটু বেশি ঝুঁকে থাকে ভালোবাসার দিকে। শুধু কি তাই, লক্ষ্য করেছি নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ঠিক সময় মতো। অথচ নিজের ধর্মকে কখনো টেনে আনেননি বিদ্যালয়ের মধ্যে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ভালোবেসেছেন গভীরভাবে। অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণু মনোভাব কখনোই দেখিনি।

ইতিমধ্যে একদিন প্রেয়ার করার সময় একটি মেয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছাত্র এবং শিক্ষক মিলে এনে শুইয়ে দেয় স্টাফরুমে একটি বেঞ্চের উপর। কিছুক্ষণ পর দেখলাম প্রধান শিক্ষক অসুস্থ মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর জানতে চাইছেন এখনো তার অসুস্থতা কি আগের মতই আছে,নাকি কমেছে। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন চিত্তে বারবার চেয়ে দেখছেন তাকে। আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছেন, তার পরিবারের কেউ এলো কিনা।
আসলে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী দরদী মন ছিল ভীষণ নরম।

কোমলে-কোঠরে গড়া একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব তিনি।
এইভাবে অনেককিছু শিখতে শিখতে কেটে গেল আমার দশ বছর। আর অন্যদিকে কমে এলো প্রধান শিক্ষকের চাকুরী জীবনের সময়।
পরের বছর জানুয়ারিতে উনার রিটায়ারমেন্ট।
একটা মৌলিক ধারণা ইতিমধ্যে আমার তৈরি হয়ে গেছিল। তাঁর আকাশ ছোঁয়া অটল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আমি নবজীবন লাভ করেছি। আমার দিশাহীন পথে বাঁচার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে পথ দেখিয়েছেন আমাকে।
এমন অটল ব্যক্তিত্বের রাশভারী প্রধান শিক্ষক একদিন সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ডাকলেন প্রেয়ার গ্রাউণ্ডে কিছু কথা বলবেন বলে। ক্লাসের শেষে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী এসে দাঁড়ালো প্রেয়ার গ্রাউণ্ডে।
সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাকেও ডেকে আনল মুস্তাক। লক্ষ্য করলাম, ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে নরম স্বরে বললেন ,"তোমাদের সঙ্গে আমার কয়েকটি কথা আছে।"< /p>

প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে তো সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী এ ওর মুখের দিকে চাইছে। শিক্ষকদের মধ্যেও একই অবস্থা। ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার রিটায়ারমেন্ট তো সামনে বছরের প্রথমেই, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এর মধ্যেই হজ করতে যাবো মক্কায়। মক্কা পুণ্য ধাম। সেখানে যেতে তো আত্মশুদ্ধি চায়। আর আমার এই আত্মশুদ্ধি ঘটাতে পারো একমাত্র তোমরাই। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চাকুরী করছি আমি এই বিদ্যালয়ে। তোমরা আমার সন্তানতুল্য। তোমাদের আমি সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে গিয়ে কখনো কখনো কাউকে বকেছি, শাসন করেছি কিংবা মেরেছিও। এটা আমার মতে গুনাহ অর্থাৎ অন্যায়। এই গুনাহ থেকে আমায় মুক্তি দিতে পারো একমাত্র তোমরা, যদি আমায় ক্ষমা করো। তাই আমি করজোরে আমার এই অন্যায়ের ক্ষমা প্রার্থনা করছি তোমাদের কাছে।

যদি কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকা বা ছাত্র-ছাত্রী আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকো বা দুঃখ অনুভব করে থাকো তাহলে আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। কথা শেষ হতে না হতেই তাঁর চোখ থেকে দু'গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। আবেগে কণ্ঠ প্রায় রুদ্ধ। তবুও রুদ্ধকণ্ঠেই অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো, "একজনের মনেও যদি এখনো আমার দেওয়া কোনো কষ্ট থেকে থাকে তাহলে আমার হজের এতটুকুও পুণ্য অর্জন হবে না,তাই দয়া করে আমাকে অন্তর থেকে ক্ষমা করে দেবেন।প্রধান শিক্ষকের এমন অনুরোধে বিচলিত ছাত্র-ছাত্রী এবং আমরা সবাই।

সবার চোখেই অশ্রু চিকচিক করছে। এক অপূর্ব শান্তিময় পরিবেশ। যেন দিব্যকান্তি এক মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের সামনে। আসক্তিহীন নির্মোহ স্বচ্ছ তাঁর দৃষ্টি। এই দৃষ্টির মধ্যে প্রোজ্জ্বল গভীর জ্ঞান যেন রূপোলী চাঁদের স্নিগ্ধ জোছনার মতো ঝরে পড়ছে ধরিত্রীর 'পর আর মুছে যাচ্ছে যত মলিনতা। তার গাম্ভীর্যপূর্ণ শাসন আজ ধূসর কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অপূর্ব সুন্দর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আজও আমাকে ছুঁয়ে যায় নিত্য সকাল-সাঁঝে আর সেই ছোয়ায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে আমার কাছে অনাবিল সুন্দর।

রচনাকাল - ২৫-০৬-২০২২

No comments:

Post a Comment

Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.