Abar Asbe Sedin Bengali Short Story written by Khushi Sarkar.
ছোটোগল্প - আসবে আবার সেদিন
লিখেছেন খুশী সরকার
দশম শ্রেণীর ক্লাসে ঢুকল দীপা।
'সুপ্রভাত প্রিয় ছেলে মেয়ে' হেসে বলেই বসলো চেয়ারে দীপা।
'সুপ্রভাত ম্যাম' ছেলেমেয়েরাও জানাল।
আজকে আমরা কবিতা পড়বো,তাইতো রফিকা?' হ্যাঁ ম্যাম'রাফিকার ছোট্ট উত্তর।
'কোন কবিতাটা আজকে পাঠ্য'- শিউলিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, গতকাল স্কুলে আসিনি,ম্যাম।
'স্কুলে না এলেও পড়াটা জেনে তৈরি করে আসতে হয়" আর ভুল করবি না,কেমন" একটু শাসনের ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে বলে দীপা।
'ঠিক আছে,ম্যাম'মাথা নিচু করে সমর্থন করে শিউলি। দীপা ক্লাসের পেছনদিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলে, এইযে শ্যামল, এদিকে, "বল, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতাটি কার লেখা?
"জানি না ম্যাম' শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে জানায় শ্যামল।
"ক্লাসের সময় জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলে জানবি কি করে, বল? জানার তো কথা নয়, তাই না? একটু শ্লেষের স্বরে বলতেই অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় দীপার। ধড়ফড় করে উঠে বসে। আবার! যেন দরজায় কেউ হাতুড়ি মারছে।দরজা খুলতেই চমকে ওঠে,ও-ও মা তুমি ?
"আরে কখন থেকে ডাকছি" ক'টা বাজে জানিস? "কয়টা গো"?
সারে নয়টা।
সারে ন-য়-টা-আ!
আমাকে তো স্কুলে যেতে হবে মা,মিড-ডে-মিলের ডিউটি আছে,ব্যস্ত হয়ে বলে দীপা।
"কাল বলেছিলি,তাই তো ডাকতে এলাম"শান্ত স্বর মায়ের কণ্ঠে।
ভাগ্যিস তুমি মনে রেখেছো, না হলে তো স্কুলে যাওয়াই হত না।চলো,চলো, আমাকে একটু ভাত দাও, আমি রেডি হয়ে আসছি।
স্কুলে পৌঁছে দেখে প্রচণ্ড ভিড়। 'মিড-ডে মিল' এর কাছে বিচিত্র পোশাকে দাঁড়িয়ে অভিভাবকরা। নবম শ্রেণীর নামের লিস্টটা নিয়ে বসে পড়ে দীপা।পাশে হিরেনবাবু, তাপসবাবু, রাখি দিদিমণি,আরো অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা বসে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসের নামের লিস্ট দেখছে।
"দিদিমণি, সেভেনের রোল 25, আরিফ হোসেন, নামটা দেখুন তো ? শুনে মুখের দিকে তাকায় দীপা। ও, আপনি আরিফের বাবা ?"
মুখে হাসি। আচ্ছা, আচ্ছা দেখে দিচ্ছি, আপনি ওর নাম তোলার রশিদটা দিন"বলতেই লুঙ্গি পরা আর গামছায় মুখ ঢাকা লোকটা এগিয়ে দেয় রশিদটা।রসিদটা হাতে নিয়ে লিষ্টে খুঁজতে খুঁজতে নামটা দেখেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরিফ। তোতলাতে তোতলাতে মাথা ঝাকিয়ে বলছে, আআমি না-আ-টক ক্করবো ম্যা-এ-ম। তখন 50 বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের প্র্যাকটিস চলছে। ওর বন্ধু শ্যাম আর মাসুদ দুজনেই 'পেটে খেলে পিঠে সয়, নাটকে অভিনয় করছে। ওরও তাই ভীষণ ইচ্ছে। ইঃ নাটক করবে,তোৎলা কোথাকার'--ওকে অন্য ছেলেরা ভেংচি কেটে বলে।
আমাকে ওরা বলছে তো-ও-অ-ৎ-লা। ও-ও-ই যে ও-ও, দৌড়ে এসে দীপার কাছে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আরিফ চেয়ে থাকে দিদিমণি কি বলে।ওর নিষ্পাপ সরল মুখটা দেখে দীপার ভীষণ কষ্ট হয়। আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, খুব জোরে বকে দেবো ওকে,কেমন? একদম কাঁদিস না, আমি তোকে ভালোবাসি না বল্?
খু-উ-ব বালোবাতো।আ-আ-মি বুদি তো।'দুই হাতে তালি দিয়ে হাসে।
যা-আ-ই এ-এ-খন' মাথা ঝাঁকিয়ে বলে আরিফ।
"পেলেন" মাথা ঝুঁকিয়ে লোকটি জিজ্ঞেস করে। চমকে উঠে দীপা ফিরে আসে বর্তমানে।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ পেয়েছি" লোকটার মুখে তাকিয়ে বলে দীপা। আরিফের বাবা চলে গেলে একরাশ বিষন্নতা ঘিরে ধরে তাকে। হয়তো এই দুই বছরে অনেকটা বড় হয়ে গেছে আরিফ।হয়তো তোতলামিটাও সেরে গেছে অনেকটা, ওর নিষ্পাপ চাহনিও হয়তো নেই আগের মতো" ভাবতে-ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে স্কুলের প্রাঙ্গণে। গোটা প্রাঙ্গনে বড় বড় ঘাস। সামনে মঞ্চটা নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে একাকিত্বের ব্যথা নিয়ে। ওদিকে চেয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে দীপার। শুনতে পায় ঘুঙুরের শব্দ। ভেসে ওঠে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে নাসিমার সেই নাচ।পাশে টেপরেকর্ডারে বাজছে,"তোমায় ছেড়ে দেবো না,তোমায় হৃদয় মাঝে রাখবো"
গানের সঙ্গে নাচছে নাসিমা। কী অপরূপ লাগছে ওকে। পেছন থেকে মাইক্রোফোনে বলছে এবার মঞ্চে আসছে কমলা দেবশর্মা। দারুণ লাগছে কমলাকে ভারতমাতার রূপে। করতালিতে উচ্ছ্বসিত মুগ্ধ দর্শক।
মঞ্চের পেছনে দিকটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একটা ভাঙা টেবিল আর একটা বেঞ্চ। মুহূর্তে দীপার চোখে ভেসে উঠলো একটা ছবি। কে যেন শুয়ে আছে টেবিলের উপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখবার চেষ্টা করে বোঝে শেখরের মুখটা।
দীপা নবম শ্রেণির ক্লাস করছে। সেদিন মর্নিং স্কুল ছিল। বেলা প্রায় এগারোটা হঠাৎ পেছনে নজর যেতেই দেখে শেখর নামের ছেলেটি যেন উসখুস করছে। পড়াতে পড়াতে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দীপা,কি রে পড়া শুনতে ভালো লাগছে না ?
"ভালো লাগছে"মুখটা কষ্টে কালো করে ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
"তাহলে উসখুস করছিস যে?"দীপা স্নেহস্বরে জিজ্ঞেস করে। "পেটে বড্ড ব্যথা ম্যাম"
"কেন, সকাল থেকে কিছু খাস নি?"
"না,ম্যাম"
"কেন?"
"খুব সকালে টিউশন থাকে"
"তাতে কি, কিছু খেয়ে যাবি তো? না হলে মাকে বলবি টিফিন বক্সে কিছু খাবার ভরে দিতে, মুড়ি চিড়া যাই হোক।" একটু রাগান্বিত স্বরে দীপা কথাগুলি বলে শেখরকে।
সকালে মায়ের প্রচুর কাজ থাকে ম্যাম। টিফিন দেওয়ার করার সময় পায় না মা, বিনয়ের সঙ্গে জানায় শেখর।
"তবুও----"
শেখরকে ব্যথায় ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে দেখে দীপা দু'জন ছেলেকে দিয়ে ওকে স্টাপরুমে এনে শুইয়ে দেয় বেঞ্চের উপর।
"কিগো দীপা দি, কি করছো ওখানে" পারমিতার ডাকে ছবিটা মিলিয়ে গেল দীপার।
"আসি" বলেই ফিরে এল দীপা স্টাফ রুমে তবুও অন্তরে জেগে রইল সেই স্মৃতি।
ওরা গেটে আসতেই দেখে, স্কুলের বন্ধ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে নাফিসা।
কিরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছিস ?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রত্না।
"আপনাদের দেখতে এসেছি, ম্যাম।" শুনেছিলাম তো আজকে মিড-ডে-মিল দেবে, তাই ভাবলাম, আপনারা তো আসবেন, অনেকদিন ধরে দেখতে ইচ্ছে করছিলো আপনাদের।
ও-ও তাই! স্নেহের ছোঁয়া দীপার কথায়।
তুই ভালো আছিস তো? মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সজল চক্ষে নাফিসা বলে, কবে স্কুল খুলবে ম্যাম? আবার আসবে সেদিন? বাড়িতে বসে পড়াশোনা করতে মন খারাপ হয় আপনাদের জন্যে।
"আমাদেরও তো করে সোনা, তোদের কথা মনে পড়ে" বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে আসে দীপার। আঙ্গুল দিয়ে স্কুলের ভেতরটা দেখিয়ে বলে, দেখ, ওই যে স্কুলটা, তোদের ছাড়া নিষ্প্রাণ। আবার যখন আসবি, তখন ওর একাকীত্বের নিষ্প্রাণতা কাটবে, ফিরে পাবে প্রাণ। আবার আসবে সেদিন। তোদের পেয়ে আনন্দে হাসবে আবার। সবাই একসঙ্গে পড়াশোনা করবি, হাসবি খেলবি। সবাই সবাইকে ভালোবাসবি আবার। স্কুলের সেই আনন্দময় প্রাণোচ্ছল ছবি ভেসে ওঠে দীপার চোখে।
তাং-২২-০৯-২০২১
No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.