Shesh Sambal Short Story Written by Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

27 Jan 2021

Shesh Sambal Short Story Written by Khushi Sarkar

শেষ সম্বল গল্পটি লিখেছেন লেখিকা খুশী সরকার।


Shesh Sambal Short Story Written by Khushi Sarkar.

শেষ সম্বল গল্পটি করোনার আবহে রচিত। করোনার কোপে দরিদ্র, কর্মহারা মানুষের জীবনের সব আশা আকাঙ্খার সলিল সমাধি হয়। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম সম্বলের প্রয়োজন। তাই বাঁচার তাগিদে একমাত্র সেলাই হয়ে ওঠে শেষ সম্বল। অসহায় কর্মহারা জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনী শেষ সম্বল গল্পে বর্ণিত।

The story Shesh Sambal is written in the atmosphere of Coronavirus. All the hopes and aspirations of the poor, jobless people are buried in the corona cope. But survival requires minimal resources. So the only stitch in the quest for survival became the (Shesh Sambal) last resort. The touching story of helpless life is told in this story Shesh Sambal.

 শেষ সম্বল গল্পটি লিখেছেন লেখিকা খুশী সরকার।

ছোটগল্প--শেষ সম্বল

লক্ষ্মী আজ একটু স্বস্তি বোধ করছে। অনেক করে ছেলের জ্বরটা নেমেছে কিন্তু বড় দুর্বল। ক'দিন যা ঝড় বয়ে গেল ছেলের উপর, যা টাকা হাতে ছিল তার সবটাই শেষ। ছেলের পথ্যের জন্য এখন টাকার ভীষণ দরকার, বারান্দায় লক্ষ্মী ছেলেকে কোলে নিয়ে ভাবছে, কি করবে এখন সে? আজকালের মধ্যে রমেনের টাকা এসে পৌঁছানোর কথা হঠাৎ মনে হলো এবার তো টাকা পাঠিয়ে রমেন ফোন করে নি, তাহলে কি টাকা পাঠায় নি? বলদ চিন্তায় পড়ে লক্ষ্মী একটা ফোন করা দরকার কিন্তু ফোন তো তার নেই। রমেনের সব ফোন‌ই তো আসে পাশের বাড়ির কমলের কাছে। মনে মনে ভাবে, একবার কমলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বাড়িতে তো আর কোনো লোকজন নেই। স্বামী-স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছেলে দীপুকে নিয়ে তার সংসার। আও রঙিন এখন দিল্লিতে থাকে কাজের জন্য। এখানে অনেক করেও সংসার তেমন চলছিল না। তাই স্ত্রী-ছেলেকে ফেলে থাকতে হয় বাইরে শুধু টাকা রোজগারের জন্য। অবশ্য দিল্লিতে ভালোই রোজগার করে সে। খেয়ে পরে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জমাতে পারে। এই গতবারই শোবার ঘরটা দিয়ে গেছে, মাসে মাসে নিয়মিত টাকাও পাঠায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফোন‌ও় করে। অথচ এবার টাকা পাঠাবার সময় ফোন করল না কেন? লক্ষ্মী চিন্তা করতে থাকে এমন সময় ছেলের দিকে চেয়ে দেখে ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে। ছেলেকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে ভাবে, এই সময়‌ই ফাঁক। এখনই কমলের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাই শুয়ে দিয়ে দরজা ভিজিয়ে দেয় এবং দ্রুত পায়ে কমলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখে কমল বাড়িতে নেই। অগত্যা ঘুরে আসে তবে ওর বাড়িতে বলে আসে, কমল ফিরলে যেন লক্ষ্মীর কাছে একবার আসে। এদিকে ঘরের চাল বাড়ন্ত শাকসবজি ও তেমন নেই কি করবে এখন লক্ষ্মী, ভাবতে ভাবতেই কমল এসে ডাক দেয় বৌদি, ও বৌদি----
ঘর থেকে লক্ষী জবাব দেয়, কমল এসেছো?
--হ্যাঁ বৌদি, তুমি নাকি আমার কাছে গিয়েছিলে?
--হ্যাঁ ভাই।
----কি ব্যাপার?
---তোমার দাদার কোনো ফোন এসেছিল?
--না তো ! ফোন করবে?
---না, আসলে----- , টাকা পাঠালে তো তোমার কাছে ফোন করে, তাই।
--- টাকা কি নেই?
---হ্যাঁ,মানে-- না, বলতে ইতস্তত করে লক্ষী।
--খুলে বলো না, বৌদি। কি হয়েছে?
--- ভাবছি এখনো কি টাকা পাঠায় নি ছেলেটার শরীরটা বড় দুর্বল হয়েছে জ্বর থেকে ওঠার পর। ওকে একটু ভালো খাবার দেয়া প্রয়োজন, তাই আর কি।
--- তাহলে ফোন করে জানবে নাকি, বৌদি?
---হ্যাঁ,একটা ফোন করলে তো ভালোই হয়। এমন সময় কমলের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আচ্ছা বৌদি, এক মিনিট, দেখি তো, কার ফোন?
মোবাইলে তাকাতেই দেখে,রমেনের নাম। অমনি লক্ষ্মীকে বলে, বৌদি, ফোন ধরবে, না আমি কথা বলবো।
--- আচ্ছা, ধরো পরে আমি কথা বলছি।
--- রমেনদা বলো। ওপার থেকে ভেসে আসে রমেনের গলা,ভাই কমল,তুই বৌদিকে বলিস, এবার আর টাকা পাঠালাম না। আমি নিজেই বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ি গিয়ে সব কথা হবে কেমন? তোরা ভালো আছিস তো? আর লক্ষ্মী দিপু ওরা কেমন আছে?
--- আমরা ওরা সবাই ভালো আছি। তবে তোমার ছেলেটার জ্বর হয়েছিল, এখন অবশ্য সেরে গেছে। তুমি কিছু চিন্তা করো না, ভালোভাবে বাড়ি এসো। তুমি বৌদির সঙ্গে কথা বলবে? কাছেই আছে কিন্তু।

--ও, তাই? দাও, দাও। কমল লক্ষ্মীকে মোবাইলটা দিয়ে বলে, ধরো বৌদি, কথা বলো।
-- হ্যাঁ গো, কেমন আছো?
---ভালো আছি। তুমি কি বাড়ি আসছো?
--হ্যাঁ, দু-একদিনের মধ্যে আসছি।
--ঠিক আছে ,সাবধানে এসো। ফোনটা কেটে দেয় রমেন। রমেনের কথা শুনে লক্ষ্মী্র চিন্তা বেড়ে যায়। কি হলো, এইতো কয়েক মাস আগে গেল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ি আসছে!
কমলের কথাগুলি শুনে লক্ষ্মীর মুখ কালো হয়ে যায়।
মনে মনে ভাবে যদি তাই হয়, তাহলে উপায়? তাদের সংসার চলবে কি করে? এখানে কি কাজ পাওয়া সহজ হবে?
লক্ষ্মীর মুখে তাকিয়ে কমল সব বুঝতে পেরে বলে, বৌদি অত চিন্তা করো না, রমেনদা কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেবে। যাও, স্নান সেরে দুটো ভাত রান্না করে খাও, এখন আমি চলি।

কমল চলে গেলে লক্ষ্মী সামান্য চাল ডালের খিচুড়ি বসায় ভাবে এতে ছেলের যদি একটু রুচি আসে আর ওর শরীরটাও এতে ভালো হবে।
সেদিনের মত যেদিকেই মা বেটা চলে যায় কিন্তু রাতে কিছুতেই চোখে ঘুম আসে না লক্ষ্মীর। ভাইরাসটা কি সত্যিই খারাপ?
ওদের ওখানে যদি হয়ে থাকে তাহলে ওর শরীরেও তো আসতে পারে, তাছাড়া ওরা তো অনেকেই একসঙ্গে একই ঘরে থাকে। এবার উপায়?
মাথার মধ্যে চিন্তা যেন কিলবিল করতে থাকে আবার টাকাও তার ভীষণ দরকার। রমেন টাকা আছে তো?--- ভাবনা হয় লক্ষ্মীর। মুহূর্তেই মনে হয়
তার,আনছো তো বটেই, এবার তো টাকা পাঠায় নি। তার মানে সঙ্গে আনছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধান্তে আসে, কি আজে বাজে ভাবছি? আগে লোকটা বাড়ি এসে পৌঁছাক, তারপর ভাবা যাবে পরিস্থিতি বুঝে।

যথারীতি সকালে উঠে লক্ষী কাজ সেরে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে চোখ মুখ ধুয়ে দেয় আজ যেন ছেলের শরীর আরও দুর্বল মনে হচ্ছে তার। ছেলের জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে। নিজের উপর বড় রাগ হচ্ছে তার। মনে মনে বলে, কেন যে লেখাপড়া করলাম না?

আজ যদি লেখাপড়া কর জানতাম তাহলে দুটো টিউশনে করেও ছেলের জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারতাম অথচ বাবা-মা তো চেষ্টা কম করে নি। তখন কিছুতেই পড়তে ইচ্ছে হলো না। বাপের বাড়ি গিয়ে যে এই সময় দাঁড়াবো, তার মুখ‌ও রাখি নি। ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিদেশখাটা রমেনকে বিয়ে করলাম পালিয়ে। তাদের সম্মানের কথা ভাবে নি একবার। তাদের রাগো যায়নি আমার উপর, তা না হলে অন্তত একবার খোঁজ নিত অবশ্য আমিও তো খোঁজ রাখি নি তাঁদের। তাঁদের লক্ষ্মী আজ অলক্ষী হয়ে গেছে। সত্যিই বুঝি আমি অলক্ষী। তা না হলে এত দুর্দশায় জীবন কাটাতে হয় নিজেকে দোষ দিয়ে লক্ষ্মী ভাবতে থাকে, ঠিক হয়েছে আমার, এটাই আমার প্রাপ্য। এমন সময় দরজায় ডাক শুনতে পায়। কান খাড়া করে শুনে চমকে ওঠে লক্ষ্মী। ঐতো রমেনের গলা। ধরফর করে এসে দরজা খুলে দেয়। চমকে উঠে রমেনকে দেখে। এ কাকে দেখছে সে!

----এ কী গো!কখন থেকে ডাকছো?
--- এইতো এখনি এসেই ডাকছি।
-- এসো এসো ঘরে এসো লক্ষী রমেনের আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে বলে, একি চেহারা হয়েছে তোমার? রাস্তায় খাওয়া-দাওয়া করো নি, নাকি?
----বলছি, বলছি। আগে একটু জল দাও তো, তেষ্টায় প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে। রোমান বসে পড়ে বারান্দায় চারদিকে কি যেন খুঁজে লক্ষ্মী গ্লাসে জল নিয়ে এসে বলে, ধরো,জল খেয়ে জিজ্ঞেস করে, বাবুকে দেখছি না তো!
--- ও, দীপু?দেখো না, ও আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
---- কেন? স্নান করিয়ে দিয়েছো?
----- না না, শরীরটা ছেলেটা ভালো নেই গো, তুমি তো জানো না, ওর ভীষণ জ্বর হয়েছিল। গতকাল থেকে আর জ্বর আসে নি অবশ্য তবে খুব দুর্বল।
---- কিছু পথ্য দাও নি?
--- না। লক্ষ্মী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,তা আর পারলাম কই?
রমেন লক্ষ্মীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,টাকা নেই না? অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে, হিসেব আমি ঠিক করেছি, টাকা থাকার কথা নয় কিন্তু-----
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লক্ষ্মী জানাই, এখন আগে স্নান সেরে নাও তো তুমি। বাইরে থেকে এসেছো, আগে একটু খাও, তারপর সব বলো। লক্ষ্যের কথা শুনে রমেন ধীরপায়ে কলে গিয়ে স্নান সেরে আসে।
ততক্ষণে লক্ষ্মী রানী খিচুড়ি করে গরম গরম খিচুড়ি খেতে দিয়ে পাশে বসে, সহানুভূতি দিয়ে স্নেহস্বরে জিজ্ঞেস করে, রাস্তায় কিছু খাওয়া হয় নি তোমার, তাই না? রমেন কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। লক্ষ্মী আবারো বলে, আমি ঠিক ধরেছি, চোখ মুখ সব শুকিয়ে গেছে। খেলে কি আর এমন হয়?
---- হ্যাঁ গো, ঠিক বলেছো। রমেন অনুরোধের স্বরে বলে, বাবুকে একটু নিয়ে এসো না, কবে থেকে ছেলেটাকে দেখি নি, বলতো?
---- আগে তুমি খেয়ে নাও। ওতো ঘুমাচ্ছে, দেখবে তো।
তারপর রমেন একটু সুস্থ বোধ করে।লক্ষ্মীও পাশে বসে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে তুমি চলে এলে যে!
----- চলে না এসে কোনো উপায় ছিল না যে।
--- কেন?
----কারখানা বন্ধ। কয়েকদিন মালিক খেতে দিয়েছিল। তারপর সংক্রমণ আরো বেড়ে গেলে সোজা বলে দিল, তোমাদের আর দায়িত্ব নিতে পারবো না। তোমরা বাড়ি চলে যাও। তবুও আমরা আশায় আশায় কয়েকজন থেকেই গিয়েছিলাম যদি অন্য কোনো কাজ করতে পারি। কাজের জন্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করলাম অনেক। কিন্তু কোনো ফল হলো না। অবশ্য মালিক কয়েকদিন থাকতে দিয়েছিল তার কারখানায় কিন্তু কোনো খাবার দেয়নি তাই অগত্যা যে টাকা জমিয়ে ছিলাম, ওই টাকাই বসে বসে খেয়ে সব ফুরিয়ে গেছে। এদিকে যখন গাড়ি চলাচল সব বন্ধ হতে বসেছে তখন আমরা যে ক'জন ছিলাম, সবাই মিলে টাকা দিয়ে একটা ট্রাক ভাড়া করে কোনোমতে আসতে পারলাম। পাঁচদিন পর হলে বোধহয় তাও সম্ভব হতো না। রমেনের কথাগুলো লক্ষ্মী অবাক হয়ে শুনছিল। যতই শুনছিল ততই যেন গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। বারবার দুর্বল ছেলেটার মুখ ভেসে উঠছিল মনে। মনে মনে ভাবছিল, এখন কি করে বাঁচাবে ছেলেটাকে? কোথায় পাবে টাকা? তবুও মুখে সহজভাবে রেখে রমেনকে বলে,অত ভেবো না তো। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। বাড়িতে যে ফিরে আসতে পেরেছো এটাই ঈশ্বরের অসীম কৃপা। আর পাঁচজন যেমন বাঁচে আমরাও ঠিক ওইভাবেই বাঁচবো। তুমি এখন একটু ঘুমাও। কতটা পথ এসেছো না খেয়ে, ভাবতে পারছো।

----- সত্যিই বড় ক্লান্ত লাগছে গো। মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে রমেন কিন্তু কতক্ষন আর!
ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভেঙে যায় আপনা থেকেই। রমেন ঘুম থেকে উঠেই দেখে, দীপু উঠে বসে আছে একা। কেমন যেন করুণ চাহনি ওর ভেতরে যেন একটা কষ্ট বাসা বেঁধে আছে। বড় বড় চোখ দুটো যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভাবতে ভাবতেই অমনি ছেলেকে কোলে নেয় রমেন। লক্ষী তখন বাইরে ঝাড় দিচ্ছে। বাপ ছেলেকে একসাথে বাইরে আসতে দেখে লক্ষ্মীর বড় ভালো লাগে। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলে, এত সুন্দর একটা ছেলে দিলে যখন হে প্রভু তখন খাওয়ানোর একটা ব্যবস্থা করে দাও। জানি, তুমি তো সবার
 তুমি শুধু বড়লোকের নও, গরিবের‌ও। ওকে সুস্থ করি কিভাবে, বলো? হে প্রভু উদ্ধার করো।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রমেন ছেলেকে কোলে নিয়ে। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। মনি তার আতঙ্ক দিন দিন যেভাবে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তাতে দিন গুজরান ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এখানে কোথায় কাজ পাবে এখন? শেষে কি না খেয়ে মারা যাবে? বিশেষ করে ওই ছোট্ট ছেলেটা। ওর তো কোনো দোষ নেই। পৃথিবীতে আমরা এনেছি অথচ খাওয়াতে পারছি না, ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছি না। বড় কষ্ট অনুভব করে রমেন। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার মায়ের একটা বহু পুরানো সেলাই মেশিনের কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেশিনটার ছবি। আনন্দে মনটা যেন ভরে উঠলো মুহূর্তে। অমনি ছেলেকে বারান্দায় বসিয়ে ঘরে গিয়ে ধুলোমলিন সেলাই মেশিনটা বাইরে আনে। আবেগে উচ্চঃস্বরে ডাক দেয় লক্ষীকে, আনন্দে বলে, লক্ষ্মী দেখো দেখো, ঈশ্বর আছেন, সত্যিই ঈশ্বর আছেন। তানাহলে মা এই মেশিনটা আমাকে দিয়ে গেলেন কেন তখন তো এর মূল্য বুঝতেই পারেনি বরং রাগ করে মাকে দু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম সামান্য এই মেশিনটা দেওয়ার জন্য অথচ আজ মায়ের এই সেলাই মেশিনটাই যেন আমার একমাত্র সম্বল হয়ে উঠলো। লক্ষীর দৌড়ে সে অবাক হয়ে মেশিনটা দেখে সত্যি তো এটার কথা তো এতদিন মনে ছিল না অমনি পরম যত্নে দুই হাত দিয়ে মেসিনটার ধুলো ঝারতে থাকে আর ঈশ্বরের নামে প্রণাম করে বলে, ক্ষমা করো প্রভু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
----- লক্ষ্মী রমেনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,হ্যাঁ গো, তুমি তো সেলাই জানো,তাই না?
রমেন গদগদ কন্ঠে উত্তর দেয়,জানি তো। পরক্ষণেই যেন আকাশে মেঘ জমে ওঠে। মনে মনে ভাবে সেই তো কবে শিখেছিলাম, এখন কি আর মনে আছে? লক্ষী বিজ্ঞের মতো হেসে হেসে বলে, একবার কেউ যদি কোনো কাজ মন দিয়ে শিখে থাকে তাহলে কোনোদিনই সে সেই কাজ ভুলে না, তাই না? তুমিও ভুলো নি নিশ্চয়ই।

---- ক্ষীণ কন্ঠে রমেন উত্তর দেয়, চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে। লক্ষী হঠাৎ রমেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, শুনলাম, এই ভাইরাসটা নাকি ভয়ঙ্কর সংক্রামক। তাই সবাইকে মাস্ক পড়তেই হবে। তাহলে আমরা যদি এখন শুধু মাস্ক‌ই তৈরি করি, তাহলে তো ভালো বিক্রি হবে, বলো? আর এই রোগটা কমে গেলে পরে অন্য কিছু শিখে নেওয়া যাবে। হাতের কাজের কোনো মার নেই, তাই না? মোটামুটি মোটা ভাত কাপড়ে ঠিক দিন চলে যাবে আমাদের।
লক্ষীর পরামর্শে রমেন বুকে বল পায়। তারপর ভালো করে ঝেড়ে একবার চালিয়ে দেখে নেই, ঠিক আছে কিনা। তারপর থানকাপর মিটার হিসেবে কিনে মাক্স বানাতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন।

কিন্তু তার চারদিকে তখন মাস্ক বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। রমেনের রোজগার আর তেমন হয় না। কোনোদিন এক বেলা তো কোনোদিন আধ বেলার খাবার জোগাড় হয় মাত্র। ছেলের চিকিৎসার ভালো পথের টাকা জোগাড় করতে দিনে দিনে অক্ষম হয়ে পড়ে। কামিনীর নতুন আশায় বালি পড়তে শুরু করে। ঠিক তেমনি দুর্দশা মাঝে হঠাৎ একদিন তারপর আর্মি শিউলি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসে বেড়াতে। শিবু এখন তার শ্বশুরবাড়িতে একজন রোজগেরে গিন্নি।সে সেলাইটাকে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে মেয়েদের ব্লাউজ বানাতে সে একজন দক্ষ শিল্পী। ছোটবেলা থেকেই রমেনকে রমেনদা বলে ডাকে। একদিন ওরা মেনে বাড়িতে বেড়াতে এসে রোমানকে মাক্স বানাতে দেখে অবাক হয়ে বলে, রমেন দাস বানিয়ে তুমি কত টাকা রোজগার করো তাতে কি সংসার চলে তারচেয়ে বরং মেয়েদের ব্লাউজ সেলাই করো অনেক বেশি রোজগার করতে পারবে তুমি। রমেন ম্লান মুখে উত্তর দেয়, না রে শিউলি, আমি তো ব্লাউজ বানাতে জানি না।

---- আমার বউ সেলাই পারে?

--- না রে, ও সেলাই শেখে নি।

---- পারবে পারবে। একটু শিখিয়ে দিলেই পারবে।

শিউলির কথা শুনে রমেন হাতে চাঁদ পায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ঠিক বলছিস তুই?ও পারবে?
------ হ্যাঁ হ্যাঁ পারবে। ঠিক আছে, আমি আজ বিকেলে এসে বৌদিকে পুরনো ব্লাউজ দিয়ে শিখিয়ে দিব।দেখো, কেমন চলে তোমার দোকান!
আশা আনন্দে রমেনের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। শ্যামা সংগীত লক্ষ্মীকে শিউলির কাছে বসতে বলে। শিউলি লক্ষ্মীকে সব বুঝিয়ে দেয় এবং বলে বিকেলে এসে কেমন করে ব্লাউজ বানাতে হয় শিখিয়ে দিবে।
লক্ষ্মী শিউলির কথায় রাজি হয়। যথারীতি বিকেলে পুরনো ব্লাউজ দিয়ে ব্লাউজ সেলাই শিখে নেয় লক্ষ্মী। তারপর নিজেরই একটি ব্লাউজের কাপড় দিয়ে যায় লক্ষীকে বানানোর জন্য।

পরদিন লক্ষ্মীর বানানো ব্লাউজ দেখে তো শিউলি অবাক! খুশিতে চিৎকার করে বলে, আরে বৌদি, করেছো কি, আমার থেকেও তো দারুন বানিয়েছো গো। লক্ষ্মী নিজের হাতকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। আনন্দে বিহ্বল হয়ে ভাবে, মানুষ চেষ্টা করলে নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে পারে।
নিজের বানানো ব্লাউজের মধ্যে লোককে দেখতে পায় নতুন আশার আলো। নতুন আশার স্বপ্ন বুনতে বুনতে সে বুঝতেই পারে নি, কখন রাত হয়ে গেছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে শরতের আকাশে রূপালী চাঁদ যেন হাসছে। দিগন্ত ভরে গেছে চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায়।


তাং--০৯-০১-২০২১
স্বত্ত্ব সংরক্ষিত।

No comments:

Post a Comment