Matribhakti in Vivekananda's Troubled life Essay by Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

21 Jan 2021

Matribhakti in Vivekananda's Troubled life Essay by Khushi Sarkar

Maternal Devotion in Vivekananda's Troubled Life.

বিবেকানন্দের বিড়ম্বিত জীবনে মাতৃভক্তি প্রবন্ধটি লিখেছেন প্রাবন্ধিক খুশী সরকার।

"মাতৃভক্তি অটুট যত
সেই ছেলে হয় কৃতি তত"
শ্রী শ্রী ঠাকুর।

প্রবন্ধ - বিবেকানন্দের বিড়ম্বিত জীবনে মাতৃভক্তি। Maternal Devotion in Troubled Life of Vivekananda

বিশ্ব-বিবেক বিবেকানন্দ আমাদের কাছে চির বিস্ময়। অতল অপার জলধি সম তাঁর জ্ঞানের পরিধি। স্বামী বিবেকানন্দের জীবন সম্পর্কে সাধারন মানুষের কৌতূহল আজ‌ও সীমাহীন। ঊনিশ শতকের ছয়ের দশকে বিস্ময়কর বিবেকানন্দের জন্ম। প্রাচীন ভারতের ধর্ম দর্শন সম্বন্ধে যখন অবিশ্বাস ও উপেক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছিল তখন নবীন আত্মারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন যুগমানব বিবেকানন্দ।

আশৈশব ধ্যানী পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ জন্মেছিলেন উত্তর কলকাতার শিমুলিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী, অভিজ্ঞ আইনজীবী।মাতা ভুবনেশ্বরী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী, সুগায়িকা এবং শ্রুতিধর। একবার শুনে যে কোনো কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন, শুধু তাই নয় তিনিও কবিতা লিখতেন এবং ছিলেন বইপাগল।

ছোটবেলা থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অত্যন্ত দুর্দান্ত প্রকৃতির। আসল নাম নরেন্দ্রনাথ। একমাত্র 'শিব শিব' মন্ত্রেই তাঁকে শান্ত করা যেত। ধর্ম বিশ্বাস ও যোগশক্তি ছিল তাঁর জন্মগত সম্পদ। যখন তখন ধ্যানে বসে যেতেন এবং এত ধ্যানস্থ থাকতেন যে একবার বন্ধুরা বিষধর সাপ দেখে পালালেও বিলের ধ্যান ভঙ্গ হয় নি।

নরেন্দ্রনাথ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ থেকে বি.এ. পাস করেন। এই কলেজে তাঁর মন ঈশ্বর জিজ্ঞাসায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তিনি ঈশ্বর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেন, সদুত্তর না পেয়ে যখন তিনি প্রায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন ঠিক সেইসময় ভগবান শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে জানতে পারেন যে তিনি ঈশ্বর দেখতে পান এবং অপরকেও দেখাতে পারেন। বিস্মিত নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের আরো নানা অলৌকিক ক্রিয়া-কলাপে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। পিতার মৃত্যুর পর শ্রীরামকৃষ্ণকে সংসারের অভাব অনটনের কথা অবগত করালে তিনি নরেন্দ্রনাথকে কালীমন্দিরে মায়ের কাছে নিজ মুখে প্রার্থনা জানাতে বলেন কিন্তু নরেন্দ্রনাথ মায়ের কাছে অর্থ না চেয়ে চাইলেন জ্ঞান ভক্তি। এইভাবেই হৃদয়ের গভীর আকাঙ্ক্ষাটি তিনি ব্যক্ত করেন। রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অবশেষে নরেন্দ্রনাথকে তিনি সর্ব শিক্ষায় শিক্ষিত করে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন।

পিতা বিশ্বনাথ দত্ত 'সুলোচনা' নামে উপন্যাস একখানি লিখেছিলেন কিন্তু অর্থাভাবে পিতা পিতামহর খুড়তুতো ভাই, ডাকবিভাগের পদস্থ কর্মচারী গোপাল চন্দ্র দত্তর নামে প্রকাশ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিফল হয়ে তিনি আইন ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন এবং সেইসঙ্গে নিলামে সম্পত্তি বেচাকেনা করে অর্থবান হন। কেনাবেচার সময় স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর নাম ব্যবহার করতেন। অনুসন্ধানী লেখক চিত্রগুপ্ত বিশ্বনাথ দত্ত সম্পর্কে বলেছেন, "আয় আশানুরূপ হলেও বেহিসাবি এবং অপরিণামদর্শী হওয়ায় তিনি দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসে (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ)। প্রবাসে থাককালীন কিছুদিন পাঞ্জাবে ওকালতি করেছিলেন এবং বাংলার বাইরে থাকার সময় বিশ্বনাথ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, পরে বিবেকানন্দ‌ও সেই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমনকি মৃত্যুর এক মাস পূর্বে পিতা বিশ্বনাথ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং শেষে ওই রোগেই মারা যান।এ সময় বিশ্বনাথের অনুপস্থিতিতে খুড়তুতো ভাই সংসারের দেখভাল করতেন। শরিকী মামলা় মোকাবিলার জন্য বৈরাগী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল। মা ভুবনেশ্বরী দেবী সম্পর্কে বিবেকানন্দ বন্ধুদের বলতেন, "আমি কি অমনি হয়েছি, আমার জন্যে আমার মা কত তপস্যা করেছেন।" তিনি মুক্তকণ্ঠ বলেছেন, "আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী"।

ভুবনেশ্বরীর গায়ের রং ছিল ফর্সা, কন্ঠ সুমধুর, প্রতি পদক্ষেপে আভিজাত্য, বুদ্ধিমতী, কার্যকুশলা, মিতভাষিনী,গম্ভীর প্রকৃতি,আলাপে মিষ্টভাব কিন্তু তেজস্বিনী। ছেলেকে তিনি বলেছিলেন," আজীবন পবিত্র থাকিও, নিজের মর্যাদা রক্ষা কর‌িও‌, কখনো অপরের মর্যাদা লঙ্ঘন করিও না, খুব শান্ত হইবে কিন্তু আবশ্যক হ‌ইলে হৃদয় দৃঢ় করিবে"।এমন মায়ের ছেলে বলেই জোরগলায় বিবেকানন্দ বলতে পেরেছেন, "যে মাকে সত্য সত্য পূজা করতে না পারে, সে কখনো বড় হতে পারে না"। মায়ের চরিত্রের আরেকটি গুণ বিবেকানন্দকে মুগ্ধ করেছিল তা হল ভুবনেশ্বরীর 'সংযমশক্তি'। তিনি বলেছেন," মা একবার সুদীর্ঘ চোদ্দ দিন উপবাসে কাটিয়েছিলেন"। এই শক্তির প্রতিফলন বিবেকানন্দের জীবনে ঘটেছিল। তিরোধানের কিছুদিন আগে কবিরাজের উপদেশে একুশ দিন তিনি জল না খেয়ে সবার বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিলেন।

মায়ের দেওয়া শিক্ষাতেই বিবেকানন্দ চরিত্রের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। একবার ভুবনেশ্বরী বড় ছেলে নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, "ফল যা হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে তাই করে যাবে, তবু সত্য কখনো ছাড়বে না"। জননী নিজেই দুঃসাহসের পথে নিজের ছেলেকে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন বলেই আমরা যথা সময়ে বীর সন্ন্যাসী কে পেয়েছিলাম। সত্যের ব্যাপারে দর-কষাকষি করেননি বলেই যুগপুরুষ' এর মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলেন ঘরছাড়া বিবেকানন্দ। বিদেশে এক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেছিলেন,"জননীর নিঃস্বার্থ প্রেম ও চরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি জীবনে যা কিছু সৎকার্য করিয়াছেন, সমস্ত সেই জননীর কৃপা প্রভাবে"।

যেমন নট আউট গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তেমনি তাঁর শিষ্য ছিলেন বিবেকানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ মাত্র পঞ্চাশ বৎসর বয়সে নশ্বর দেহত্যাগ করলেও আজো তাঁর রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর দিব্যচক্ষু দিয়ে প্রধান চেলাকে নির্বাচন করে সস্নেহে লালন করেছিলেন। দুজনের দেখা-সাক্ষাতে গড়ে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য আন্দোলন।অসাধ্য সাধন করলেন প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথের জন্য। বিবেকানন্দ কপর্দকহীন হয়েও প্রভুর নামাঙ্কিত যে আন্দোলন তৈরি করলেন তা ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম। ভগবান বুদ্ধের ভুবন বিজয়ের পর প্রথম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে নৈষ্ঠিক পুরোহিত হয়েও নির্বাচন করে গিয়েছিলেন এক কায়স্থ সন্তানকে, ঘটিয়েছিলেন অসম্ভব ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন 175 বছরেও অপ্রতিহত। তার মূলেই ছিল সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের ভূমিকা। সন্ন্যাসী হওয়া সহজ নয়, সে এক দুর্গম জীবনযাত্রা। দিবারাত্র বিপুল নিষ্ঠা ও সাধনায় সন্ন্যাস জীবন সকলের কাছে শ্রদ্ধার ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী বিষয়ে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, "সন্ন্যাসী শব্দের অর্থ যে ব্যক্তি সম্যকভাবে ত্যাগ করেছে"। সন্ন্যাসী সম্প্রদায় অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুও এ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রাচীন বেদেও এর উল্লেখ আছে। সন্ন্যাসী দের সম্পত্তি কিংবা সংস্থা কিছুই থাকে না এবং বিয়েও করে না। তাঁদের একমাত্র বন্ধন গুরু-শিষ্যের। গুরু পিতার‌ও অধিক। এই বিষয়ে বিবেকানন্দ মনে করেন,"পিতা আমায় জন্মদান করেছেন কিন্তু গুরু আমায় মুক্তির পথ দেখিয়েছেন সুতরাং পিতা অপেক্ষা গুরু মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করি"।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর। দুজনেই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। 'বিবেকানন্দের জীবন' গ্রন্থে রোমাঁ রোলাঁ বিবেকানন্দের দেহবিবরণ দিয়েছেন, ওজন ছিল 170 পাউণ্ড, "দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণদেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ ( 5 ফুট সারে 8 ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ট পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কন ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমন্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত ঘন দুটি চোখ। তাঁহার চক্ষু দেখিলে প্রাচীন সাহিত্যের সেই পদ্মপলাশের উপমা মনে পড়িত। বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিশ্রমে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চক্ষু। ভাবাবেগে ছিল তন্ময়, চেতনার গভীরে তাহা অবলীলায় অবগাহন করিত,রোষে হইয়া উঠিত অগ্নিবর্ষী।সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল হইতে কাহার‌ও অব্যাহতি ছিল না" ।

রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, "বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বর ছিল 'ভায়োলন সেলো' বাদ্যযন্ত্রের মতন, তাহাতে উত্থান-পতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তাহার ঝংকার সমগ্র সভাকক্ষে এবং সকল শ্রোতার হৃদয়ে ঝংকৃত হইত।"

কঠিন সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে কঠিনতম দুঃখের মোকাবিলার দুর্লভ শিক্ষা পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ গুরুর কাছে। তাই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও পরম অবজ্ঞাভরে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "আমার তো জন্মই হয় নি, সুতরাং মৃত্যু হবে কী করে?" বৈরাগ্য ও ভালোবাসায়, আকর্ষণ ও বিকর্ষণের পরস্পর বিরোধী শক্তি বিবেকানন্দের জীবনকে এক আশ্চর্য রঙিন আভায় আলোকিত করে রেখেছিল। হয়তো সেই কারণেই রামকৃষ্ণ ও সর্বস্বত্যাগী এই বিবেকানন্দ আমাদের সকলের বোধের উর্ধ্বে।

স্বামী বিবেকানন্দের 39 বছরের সীমিত জীবনকালে যে বিরামহীন বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে মনে হয় আমাদের এই হতভাগ্য দেশে মানুষের পরম পূজ্যগণ সর্বক্ষেত্রেই দুঃখের অবতার। আমরা এখন তাঁকে প্রজ্জ্বলিত সূর্যের সঙ্গে তুলনা করি, সুসজ্জিত সভাগৃহে তাঁর কীর্তিকাহিনী ঘোষণা করি কিন্তু জীবৎকালে সমকালের মানুষের কাছে তিনি যা পেয়েছেন তা একত্রিত করলে লজ্জায় অধোবদন হতে হয়। সমকালে তিনি শুধু অবহেলা ও অপমানিত‌ই হন নি, কত রকমের কুৎসা,চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র ও সুপরিকল্পিত আঘাত সহ্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার বিড়ম্বিত জীবনের পাথেয় শুধু সন্ন্যাসের অধ্যাত্ম শক্তি ছিল না, ছিল পিতৃদেবের বাণী। একদিন নরেন্দ্রনাথ বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সংসারে কিভাবে চলা উচিত? উত্তরে পিতা বলেছিলেন, "কখনও কোনো বিষয়ে অবাক হবি না"। পিতৃদেবের এই মূল্যবান কথা তিনি মাথায় রেখেছিলেন যে প্রত্যাশিত এবং অপ্রত্যাশিত সূত্র থেকে আঘাত অপমান মানুষকে আহত করতে পারে--এই মানসিক হুঁশিয়ারিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। আর দ্বিতীয় মূল্যবান কথা মা ভুবনেশ্বরীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন,"খুব শান্ত হবে, কিন্তু আবশ্যক হলে হৃদয় দৃঢ় করবে"। মায়ের এই নির্দেশ তিনি কখনও অমান্য করেন নি।

দুর্গম পথের যাত্রী বিবেকানন্দের বিড়ম্বনা শুরু হয়েছিল স্কুল জীবনেই। শিক্ষকের ভ্রান্ত ধারণায় দৈহিক শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। এমনকি এক রাগী শিক্ষক বিবেকানন্দের কান এত জোরে ধরে টেনে ছিলেন যে কান ছিঁড়ে গিয়েছিল। শেষে বিদ্যাসাগর মহাশয় নির্দেশ করে ছাত্রদের এমন শাস্তির প্রথা তুলে দিয়েছিলেন। শুধু ছাত্র হিসেবে নয়, শিক্ষক হিসেবেও বিবেকানন্দ চূড়ান্ত অপমানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ডুবন্ত সংসারকে রক্ষা করার জন্য নরেন্দ্রনাথ অফিসপাড়ায় কর্মসন্ধানে সামান্য একজন কেরানির কাজের যোগ্যতাও নিয়োগকর্তারা তাঁর মধ্যে খুঁজে পান নি। পরে ১৮৮৪ সালে 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত' এর রচয়িতা হেডমাস্টার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের চেষ্টায় সুকিয়া স্ট্রিট মেট্রোপলিটন স্কুলের মেন ব্রাঞ্চে নরেন্দ্রনাথের কাজ জোটে। সেখানে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যান কিন্তু ওই বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জামাতা চেয়েছিলাম যে হেডমাস্টার তার কথামত চলবে কিন্তু নরেন্দ্রনাথের প্রকৃতি ছিল অন্যরূপ। তাই তিনি উচ্চতম দুই শ্রেণীর ছাত্রদের দিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন যে, নতুন হেড মাস্টার পড়াতে পারেন না।' ফলে বিদ্যাসাগর তাঁকে স্কুলে আর না আসার কথা জানিয়েছিলেন ছিলেন শ্রী মহেন্দ্রনাথ মহাশয়ের মারফতে।

কর্মের সন্ধানে নিরন্তর ঘুরে ঘুরে বিফলমনোরথে বিবেকানন্দ ফিরে সংসারের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল যে, "স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতি বিরল। দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নেই"। সংসারটাকে তাঁর দানবের রচনা বলে মনে হতো। দারিদ্র্যের কঠোর পেষণে পিষ্ঠ নরেন্দ্রনাথকে অসুদপায়ে উপার্জনকারী বাল্যবন্ধু তার দলে টানতে সচেষ্ট হয়েছিল। এক সঙ্গতিপন্ন রমণী তার এই দুরবস্থার অবসরে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে দারিদ্র্য দুঃখের অবসান করতে চেয়ে ছিলেন। এইভাবে ক্রমশ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসহীন হয়ে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি অনুভব করে একদিন বিবেকানন্দ বাড়ির পাশে রকে জড় পদার্থের ন্যায় পড়ে থাকলেন। সেই সময়েই তিনি দৈবশক্তি প্রভাবে ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতা ও অপার করুণার সামঞ্জস্যহীন একের পর এক ছবি উত্তোলিত হতে হতে হঠাৎ যেন সবকিছুর স্থির মীমাংসায় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তারপরে উঠে বাড়ি ফিরবার কালে দেখলেন তার শরীরে আর ক্লান্তি নেই, মন অমিত বল ও শান্তিতে পূর্ণ।

প্রবল নিন্দার পরিবেশেও বিবেকানন্দ ধৈর্যশীল ও নীরবতা অবলম্বন করতেন কিন্তু মায়ের কাছে এইসব চারিত্রিক নিন্দা পৌঁছালে কি হবে, এই বিষয়ে তিনি বিচলিত হতেন। ঘরে বাইরে নানা প্রকার অপবাদের সম্মুখীন হয়েছেন বিবেকানন্দ। এমনকি শিকাগো সাফল্যের পরবর্তী পর্যায়ে যখন তিনি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হয়ে ভারতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখনও তিনি অপরের অকারণ নিপীড়ণ থেকে মুক্তি পান নি। এমনকি বিবেকানন্দের সন্ন্যাস নেওয়ার বিষয়ে মাদ্রাজি ব্রাহ্মণদের কাছেও তিনি বিড়ম্বিত হয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষে শুধু এ কথায় বলা যায় যে, সম্মান ও অসম্মান, প্রশস্তি ও কুৎসা, সেবা ও অবমাননা, জয়মাল্য ও অবিচার, ভালোবাসা ও তীব্র অবিচার, পুষ্পাঞ্জলী ও অন্যায় অবিচার, শ্রদ্ধা ও ঘৃণা চরিত্র চরিত্রপূজা ও চরিত্র হননের সেই বিচিত্র ভূখণ্ডে আমাদের যুগের সবচেয়ে স্মরণীয় বিস্ময়কর চরিত্র দাঁড়িয়ে রয়েছেন যিনি একইসঙ্গে নীলকন্ঠ ও মহামানব।

বৈরাগ্যের এই ভারতে স্মরণাতীত কাল থেকে মুক্তি সন্ধানী মানুষ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন। সংসারের মায়া বন্ধনকে তারা ভালো চোখে দেখেন না তবুও যার থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া যায় তাকে কি কোনো অবস্থাতেই পরিপূর্ণ ত্যাগ করা যায়? সকল বন্ধন ছিন্ন করার জন্য সন্ন্যাস পথের পথিক কে আত্মশ্রাদ্ধ করতে হয় কিন্তু সন্ন্যাসীও তো মানুষ। গর্ভধারিণী জননীর ঋণ এবং মোক্ষের আহ্বান যতই ভিন্নরূপী হোক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা কোনো যুগেই এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে পারেন নি। একালের সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, "'সন্ন্যাস'অর্থ সংক্ষেপে মৃত্যুকে ভালোবাসা। আত্মহত্যা নয়-- মরণ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজেকে সর্বতোভাবে তিলে তিলে অপরের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করা"। অথচ তার প্রতিবেশী মহাকবি বলেছেন, "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়"। বন্ধন মুক্তির স্বাদ গ্রহণের জন্য সত্যসন্ধানীর বারবার জীবন সমুদ্রে অবগাহন।

বিবেকানন্দ মাত্র 24 বছর বয়সে বৈরাগী হয়ে সর্ব বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন, বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন অনন্তকালের মুক্তির বাণী। আসলে তিনি নরত্তোম। আত্মশ্রাদ্ধের পর সর্ববন্ধনমুক্ত হয়েও একইসাথে সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী, বৈরাগ্য ও প্রেমকে আপন বিবেকের মধ্যে সহ-অবস্থানের অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। প্রিয় জনের মৃত্যুতে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে রোদন করতে দেখে জনৈক ব্যক্তি বলেছিলেন, "সন্ন্যাসীর পক্ষে শোকপ্রকাশ অনুচিত"। বিবেকানন্দ উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, "বলেন কি, সন্ন্যাসী হইয়াছি বলিয়া হৃদয়টা বিসর্জন দিব"।প্রকৃত সন্ন্যাসীর হৃদয় সাধারণ লোকের অপেক্ষা আরো কোমল হওয়া উচিত। হাজার হোক,আমরা মানুষ তো বটে।" তারপরেই সেই অচিন্তনীয় অগ্নুৎপাত, "যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে উপদেশ দেয়, আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না"। মনুষ্যত্বের এমন অকুতোভয় শত বছরের ইতিহাসে আর কেউ বলেছেন কিনা জানা নেই।

মাতৃভক্তি ও মাতৃ আনুগত্যের নজির অষ্টম শতকের শংকরাচার্য। তিনিও নিত্যান্ত তরুণ বয়সে অর্থাৎ মাত্র 16 বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন। বেঁচে ছিলেন অত্যন্ত কম সময়, মাত্র 32 বছর। গর্ভধারিনীর প্রতি আনুগত্যে সন্ন্যাসের জন্য মাতৃ অনুমতি চাইলে শংকরাচার্য, গর্ভধারিনী বলেছিলেন," বাবা তুমি চলে গেলে কে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে? আচার্য শঙ্কর বলেছিলেন, "আপনি প্রসন্নমনে আমার গৃহ ত্যাগের অনুমতি দিন, আপনার সৎকার আমি যেখানেই থাকি, যথাসময়ে এসে আমিই করব। সন্ন্যাসীর এই কাজ নিষিদ্ধ, তবুও আপনার জন্য আমি এই কাজ করবো"। একদিন প্রবাসে থাকাকালীন মাতৃস্তন্যদুধের স্বাদ অনুভব করে ফিরে এসে দেখেন কালাডি গ্রামে মা অন্তিম শয্যায় শায়িত। পুত্রকে দেখে মা সব যন্ত্রণা ভুলে গেলেন। আত্মীয়দের বহু অপমান সহ্য করেও মাতার সৎকার করেছিলেন শংকরাচার্য নিজে অগ্নিমন্থন করে।

মাতৃপ্রেমে অপ্রতিদন্ধি সন্নাসীর মতো নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের মাতৃপ্রেম স্মরণীয়। শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস নিয়ে চলে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন মায়ের অনুমতির জন্য। নবদ্বীপে শচীমাতাকে দেখে প্রভু দণ্ডবৎ করলেন। পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে শচীদেবী কাঁদতে লাগলেন। প্রভু কেঁদে-কেঁদে বললেন, "শোনো মা, এই শরীর তো তোমারই দেওয়া, আমার কিছুই নয়। তোমার থেকেই জন্ম, তুমি লালন-পালন করে এত বড় করেছ, কোটি জন্মেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না, যদিও সন্ন্যাস নিয়েছি, তা বলে তোমাকে কোনদিন ভুলতে পারবো না।" প্রভু শচীমাতার চরণ বন্দনা করে নীলাচলে যাত্রা করলেন। প্রতিবছর চৈতন্যদেব প্রিয় জগদানন্দকে মায়ের কাছে পাঠাতেন। পুত্র বিচ্ছেদের দুঃখিত জননীকে প্রভুর সংবাদ দিয়ে আশ্বস্ত করার জন্য। এই মাতৃভক্ত শিরোমনি চৈতন্য সন্ন্যাস নিয়েও মাকে সেবা করে গেছেন চিরদিন। বিবেকানন্দ‌ও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, "যে মাকে সম্মান না করতে পারে, সে কখনো বড় হতে পারে না"। মাতৃপূজা সাধারণ স্বীকৃতি আমাদের দেশে থাকলেও তার সরল পুনর্ঘোষণা তেমন মেলে নি। মাতৃপ্রেমী, মাতৃ পূজারী, পূতচরিত্র বৈরাগীকে তাই শতাব্দীর দূরে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানাতে হয়, তাঁরা হয়ে ওঠেন আমাদের পরম পূজনীয়।

বিলু অর্থাৎ বিবেকানন্দ ভুবনেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র না হয়েও পরবর্তীকালে তাঁকেই বড় ছেলের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। তাই সংসার ত্যাগী হয়েও সেই বিরাট মানসিক দায়িত্বে তিনি কোনদিন স্বার্থপরের মত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেন নি। এই পৃথিবীতে সন্ন্যাসী অনেকেই হয়েছেন কিন্তু পরিবার ও বৈরাগ্যের উভয় সংকট এবং তার বিস্ময়কর সমাধান‌ই বিবেকানন্দকে বিবেকানন্দ করে তুলেছে। বিবেকবান বিবেকানন্দ কোনোদিনই গর্ভধারিণী জননীকে ভুলতে পারেন নি। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, "এই বিপুল সংসারে আমার ভালোবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন তবে তিনি আমার মা।" আরেক জায়গায় স্বীকারোক্তি তাঁর, "জননীর নিঃস্বার্থ স্নেহ ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হ‌ওয়াতেই তিনি সন্ন্যাসজীবনের অধিকারী হইয়াছেন এবং তিনি জীবনে যা কিছু সৎকার্য করিয়াছেন,সমস্ত‌ই-- সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে"।

স্বামী ববিবেকানন্দের চরিত্রের বুনিয়াদ গড়েউঠেছিল কার শিক্ষায়?

পরিব্রাজক জীবনেও তিনি মায়ের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারেন নি, এমনকি শতসহস্র সমস্যায় জড়িত মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসীর বিবেকে গর্ভধারিণী জননীর প্রতি কর্তব্যবোধের অগ্নি দিবারাত্র ধিকিধিকি জ্বলেছে। তাঁর চিন্তা দেহাবসানের পর এই স্বার্থপর সংসারে তাঁর মাকে কে দেখবে? এ কালের বিবেকময় সন্ন্যাসী কামিনীকাঞ্চন অতি সহজে ত্যাগ করলেও ভালোবাসা এবং কর্তব্যকর্মকে বিসর্জন দিতে রাজি হন নি বহুকাল আগের শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের মতন। বিবেকানন্দ গর্ভধারিনীকে আজীবন এই সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বিবেকানন্দ হতে পেরেছেন এবং এই জন্যই তিনি হৃদিপদ্মাসনে আজো পূজিত। গর্ভধারিনীকে না জানলে কোনো মানুষকেই পুরো জানা যায় না তাই বিবেকানন্দকে জানতে হলে আমাদের তাঁর মাতৃভক্তি জানতেই হবে।

তবুও চির বিস্ময় বিবেকানন্দের ৩৯ বছরের ক্ষণজন্মা জীবনের তিনশ নব্ব‌ই বছরেও যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না।

The Essay 'Mother Devotion in ironic life of Swami Vivekananda' is written by essayist Khushi Sarkar.

কলমে-খুশী সরকার
তাং--১৭-০১-২০২১

No comments:

Post a Comment