Bijayar Bisarjan Short Story written by Poet Khushi Sarkar.
বিজয়ার বিসর্জন ছোট গল্প টি লিখেছেন কবি খুশী সরকার।
দশমী দূরে একটা আম গাছের আড়াল থেকে দেখছে দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। চিতার আগুনে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিজয়ার সেই ছোট্টবেলা। তার ভিতরে প্রতিশোধের আগুন যেন আরো দ্বিগুণ জ্বলছে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু বড় নিরুপায় সে। দুগাল ভেসে যাচ্ছে অশ্রুর বন্যায়। যেন সেই বন্যা ডিঙিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছোট্ট বিজয়া চাইছে মায়ের কোলে উঠতে কিন্তু মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকবার কি আর জো আছে দশমীর। অনেক বেলা হয়ে গেল ইস্ ! ঘরের দিকে লক্ষ্য করে বলে দশমী,ধরো, মেয়েটাকে। আমার তো মেয়েটাকে নিয়ে বসে থাকলে পেট ভরবে না ?
একটা আস্ত কাতর স্বর ঘরের দরজা ডিঙিয়ে ভেসে আসে,আর যে পারি না গো, বড় কষ্ট আমার।
দশমী ওই কথায় কান না দিয়ে আরো জোরে বলে, তাড়াতাড়ি ধরো।
হন্ - হন্ করে দশমী মেয়েকে অসুস্থ বাপের কাছে রেখে কাজের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কাজের বাড়ির মনিব ঘোষালমশাই বড় ভালো মানুষ। বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হলে গিন্নিকে বলে দেন, দশমীকে একটু মাছ ভাত দিও, ওর মেয়ের জন্য। গিন্নিও দশমীকে এটা সেটা প্রায় দেন। খুশি হয়ে দশমী মনিব বাড়ির ভালো মন্দ খাইয়ে খেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেঁচে আছে। একটা দুঃখ তো আছেই বেশিক্ষণ মেয়েকে কাছে না পাওয়ার। তবুও শান্তি মেয়ের মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া দেখে।
কয়েক বছর পর দশমীর স্বামী শরতের শিউলি ফোটা ভোরে একদিন চলে গেল কাউকে কিছু না জানিয়ে। চোখের জলে বিদায় দিল দশমী। তবুও স্বামী হারানোর দুঃখ ভুলেছিল শুধু মেয়েকে দেখে।
সেই ছোট্ট বিজয়াকে সঙ্গে নিয়েই কাজে যেতে লাগল দশমী। এভাবেই একদিন নজরে পড়লো দশমীর মেয়ে ডাগর হয়ে উঠেছে। বিজয়া যতই বড় হয় ততই চিন্তা বাড়তে থাকে দশমীর। কাজের বাড়িতে সারাদিন আতঙ্কে থাকে দশমী। সামনের শ্রাবনে চৌদ্দতে পা দেবে বিজয়া। একদিন তো বিজয়া দশমীকে বলেই দেয়, মা আমি আর তোমার সঙ্গে তোমার কাজের বাড়ি যাব না। আমার রোজ রোজ বাবুদের বাড়ি যেতে ভালো লাগে না।
---- তা কী করবো মা? আর তো কোনো উপায় দেখি না।
---- আমি এখন বড় হয়েছি,মা। আমি একাই থাকতে পারবো বাড়িতে। তুমি অত চিন্তা করবে না তো?
সকালে কাজে যাওয়ার সময় সেদিন প্রথম বিজয়াকে রেখে যায় দশমী। কিন্তু কাজের বাড়িতে কিছুতেই মন বসে না তার, বারবার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে, মেয়েটা বাড়িতে একাই যে কি করছে?
বারবার করে বলে দিয়েছে সে, আমার খোঁজে কেউ এলেও দরজা খুলবি না। বলবি, মা ঘুমিয়ে আছে, পরে এসো। আজকাল যা দিন পড়েছে, কাউকে বিশ্বাস নেই। তবুও দশমীর চিন্তা কমে না। তাড়াতাড়ি সেদিন ফিরে আসে বাড়িতে, এসে দেখে দরজা সত্যি সত্যি বন্ধ। বুকে বল পায় দশমী। মেয়ে তার কথা বোঝে, শোনে। মনে মনে ভাবে, মেয়ে তার লেখাপড়া না শিখলেও বুদ্ধি রাখে। আনন্দে মনটা ফুলে ওঠে দশমীর। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন। সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত শরীরটা যখন বিছানায় ফেলে দেয় তখন দশমীর যেন পরম শান্তি। কিন্তু হঠাৎই চিন্তাটা যেন পেয়ে বসেছে তাকে। ঘুম আসে না তার চোখে। বিজয়া সাবালক হয়ে উঠেছে, দেখতেও খুব একটা খারাপ না। কিন্তু সমাজ অরণ্যে বুনোর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে। না জানি কখন নজরে পড়ে যায়! দশমীর নির্ঘুম চোখে ভেসে ওঠে ঘন্টুর বোবা মেয়েটার দুর্দশা। দিন এনে দিন খাওয়া ঘন্টুর বোবা মেয়েটাকে ঘরে একা পেয়ে কিভাবে নরপিচাশ বাবলু খুবলে খেয়েছিল। এখনো তার কথা মনে পড়লে শিউরে উঠে সে। ভাবতে ভাবতেই দশমীর মেয়েটির দুর্দশায় চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। কিভাবে সে বিজয়ার বিয়ে দেবে? ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখে সূর্য অনেকটা উপরে উঠে গেছে। ধড়ফড় করে উঠে মেয়ের জন্য সামান্য চাল ফুটিয়ে রেখে চলে যায় কাজের বাড়ি। বিজয়াকে জাগিয়ে বলে যায়, বেলা হলে খেয়ে নিস, মা। আর হ্যাঁ, দরজা সবসময় বন্ধ রাখবি, ভুলিস না যেন।
এদিকে দেখতে দেখতে পুজো এসে গেছে। চারদিকে কাশফুলের মেলা, আকাশে ভাসে মেঘের ভেলা। মনিবের বাড়িতে অনেক কাজ ধোয়া-মোছা, পুজো বলে কথা, অনেক-- অনেক---
কিন্তু একটু শান্তি পাই এই ভেবে যে এখন করোনার আবহে কেউ কারো বাড়ি যায় না। তাই বিজয়াকে নিয়ে দশমীর চিন্তা যেন একটু কম আজকাল।
ষষ্ঠী, সপ্তমী পেরিয়ে আজ অষ্টমী। বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজো। তারা গরীব হলেও পাশে ক্লাবের পূজোই আনন্দ করে খুব। যতই করো না থাক মানুষের আনন্দকে থামিয়ে রাখা যায় না। দশমী ভাবে বছরে একটি বার-ই তো। অষ্টমীতে অঞ্জলি না দিলে কি হয়?
তাই মনিবের বাড়ি থেকে আজ সে ছুটি নিয়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়েকে বলে, হ্যাঁ রে মা, আমরা তো গরিব মানুষ। আমাদের তো আর নতুন জামাকাপড় নেই। গতবারের যে জামাটা বাক্সে তুলে রেখেছিস, সেটা স্নান করে পরে নে। চল, মা বেটি অঞ্জলি দিয়ে আসি।
বিজয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বড় নিরীহ মেয়ে বিজয়া। সে বোঝে মায়ের অবস্থা।
তার মায়ের পক্ষে তেমন আর তো কেউ নেই, কেবল আছে বাপের পক্ষে একজন পিসি। তারা গরিব বলে তাদের সঙ্গেও তেমন যাওয়া আসা নেই। তাই বিজয়া মায়ের কথা মত পুরনো জামা পরেই মায়ের সঙ্গে অঞ্জলি দিয়ে আসে। সামান্য চাল ডাল দিয়ে দশমী খিচুড়ি রান্না করে। সেই খিচুড়ি মা, মেয়ে খায় মহানন্দে। হঠাৎ বিজয়া খেতে খেতে মাকে বলে, মা তুমি কাছে থাকলে আমার ভীষণ ভালো লাগে কিন্তু যখন থাকো না তখন বড় একা লাগে মা। ভয় ভয় করে।
----- কেন রে মা? আমি তো তোর সঙ্গেই থাকি সবসময়। কাজের জন্য মনিব বাড়ি যাই ঠিকই কিন্তু মনটা পড়ে থাকে তো তোর কাছেই। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল ? আমার লক্ষী মেয়ে তুই। তুই তো সব বুঝিস মা। কাজে না গেলে আমাদের চলবে কেমন করে, বল ?
বিজয়া চুপ করে থাকে। দশমী সব বুঝে কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পায় না। শুধু ভাবে, মেয়ে বড় হয়েছে, ওর একটা বিয়ে দিতে পারলেই তার শান্তি। মা, মেয়ে গল্প করে কাটিয়ে দেয় সেদিন।
নবমীর দিন আবার সেই একঘেয়েমি জীবন। আবার কাজে যোগ দেয় দশমী। বিজয়া ঘরে একা একা একটু সাজগোজ করে বসে থাকে মায়ের অপেক্ষায়। পরদিন দশমী। কাজে যাওয়ার সময় বিজয়াকে বলে, জানিস তো মা,আজ মনিববাড়ি দারুণ খাওয়া-দাওয়া। আমি তোর জন্য সব আনবো, ওরা তো তোর জন্য সব দেবে বলেছে।
বিজয়া আনন্দে গদগদ হয়ে বলে, তাই?
তাহলে আর আজ আমার জন্য কিছু করো না,মা। কালকের যে বাসি রুটি আছে, আমি তা-ই খেয়ে নেব।
------ ধুর পাগলী, অতক্ষণ রুটি খেয়ে থাকা যায় নাকি ? অবশ্য আজ রান্না হতে মনিব বাড়িতে বেশ দেরি হবে। কত রান্না ! মাছ মাংস পোলাও পাট ভাজা আরো অনেক---
শুধু একটু দেরি হবে এই যা। আমি তোর জন্য সব নিয়ে আসবো কেমন?
----- ঠিক আছে মা। আমি তোমার জন্য বসে থাকবো কতদিন ভালো খাবার খায় না, বলো? আজ পেট ভরে সব খাবো।
যাবার সময় দশমী বিজয়াকে দরজা বন্ধ করতে বলে চলে যায়। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। দশমী হনহন করে দরজায় এসে ধাক্কা মারতেই দরজা খুলে যায়। দরজা খোলা দেখে দশমীর তো চক্ষু চড়কগাছ। তারপরেই রাগ হয় দশমীর বিজয়ার উপর।
মনে মনে বলে, দরজাটা বন্ধ করতে বলে গেলাম মেয়েটাকে, আর দরজা না দিয়েই শুয়ে পড়েছে সে। এ তো যে কোনোদিন অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে। রেগে চিৎকার করে বলতে থাকে, এতো বড় ধাড়ী মেয়ে, শুধু খাস আর পড়ে পড়ে ঘুমাস? দরজা খুলে শুয়ে পড়েছিস? যদি কোনো লোক ঢুকে যেত তো, কি হত তোর পোড়ারমুখী? বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে দেখে মেয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে, আরও রাগ বেড়ে যায় দশমীর।
দশমী বলতে থাকে, কি রে উঠবি?
তোর জন্য কি না মনিব বাড়ি থেকে চেয়ে খাবার নিয়ে আসলাম, তুই এখনো শুয়ে থাকবি ?
উঠবি? না শুয়ে থাকবি?
িজয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার দশমী বলে, কি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম রে বাবা, এতো ডাকছি কানেই যায় না! তাড়াতাড়ি ওঠ। বিকেল হয়ে গেল তো। একটু পরেই তো ঠাকুর বিসর্জনে যাবে সবাই। দেখবি না? এবারও কোনো উত্তর না পেয়ে বিজয়া়কে ধাক্কা দিতেই কেমন যেন ঠান্ডা লাগে তার। চমকে উঠে দশমী। বিজয়ার শরীর ঠান্ডা কেন?
পরক্ষণেই আবার ডাকে, ওঠ না মা। দেখ তোর জন্য কত খাবার এনেছি। বলেই হাত ধরে টানে কিন্তু হাত টানতেই দেখে বিজয়ার শরীর শক্ত, নড়ে না। সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে নাকের সামনে। নাঃ, নিঃশ্বাসও পড়ে না। থর থর করে কেঁপে ওঠে বুক। চারদিকে তাকাতেই হঠাৎ নজরে আসে বিজয়ার পা বেয়ে রক্তের স্রোত। আর সন্দেহ নেই। অকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে দশমী, পাগলের মতো ছিঁড়তে থাকে চুল। ওরে, আমার সর্বনাশ কে করল রে? বুকফাটা কান্নায় বলতে থাকে, আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলল রে, আর দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বিজয়াকে। মুখে মুখ রেখে বলে, ওমা, মাগো, মা বল্, বল মা, কে করল তোর এমন দশা?
সারা ঘরময় দশমীর কথার যেন প্রতিধ্বনী হতে থাকে, কে করলো তোর এমন দশা?
নিথর বিজয়া পড়ে রয় বিছানায় সমস্ত খাবার ছড়িয়ে বুকে করাঘাত করে বুকফাটা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে দশমী। তার বুকফাটা কান্নায় ছুটে আসে কয়েকজন পাড়ার প্রতিবেশী। তার চিৎকারে সবার চোখে জল কিন্তু দশমীর প্রশ্নে নিরুত্তর সব। দশমী মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকে পাগলের মত আর বলতে থাকে, হায় ভগবান! শেষ পর্যন্ত হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলাম না মেয়েটাকে, আমার প্রতিমাকে আজ দশমীর দিনেই তাকে কেড়ে নিলে। যে বা যারা তার এই দশা করেছে হে ঈশ্বর, তুমি তাদের বিচার করো। হয়তো আমরা গরীব বলেই মানুষের আদালতে আমরা সঠিক বিচার পাবো না কিন্তু তোমার আদালতে সবাই তো সমান, তুমি তাঁর বিচার করো প্রভু। গরিবের অভিশপ্ত জীবন এই ভাবেই কি চিরকাল শেষ হয়ে যাবে ?
অবশেষে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বিজয়ার মরদেহ পাড়ার কয়েকজন যুবক শ্মশানে নিয়ে যায়।
দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে চিতা।
এই জ্বলন্ত চিতার কালো ধোঁয়ায় দশমী যেন দেখতে পায়, তার প্রাণের পরম ধন বিজয়া যেন মাটির প্রতিমার ভূষণে অলংকৃতা হয়ে পিত্রালয় ছেড়ে পতির আলয়ে স্বর্গ রথে চলেছে।
বাইরে তখন বিসর্জনের ঢাক বেজে চলেছে। কানে ভেসে আসছে, 'আবার এসো মা'।
তাং--৩১-১০-২০২০
No comments:
Post a Comment