Aloy Andhar Short Story Written by Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

17 Nov 2020

Aloy Andhar Short Story Written by Khushi Sarkar

 Aloy Andhar short story written by Khushi Sarkar


আলোয় আঁধার ছোটগল্পটি লিখেছেন খুশী সরকার।


মর্মার্থঃ-
দীপাবলীর আলোর উৎসব। এই উৎসবে গোটা পৃথিবী আলোয় ঝলমল করে, অথচ কোন কোন মনের ভিতর রয়ে যায় গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পৌঁছতে পারে না দীপাবলির আলো। এই অন্ধকার জীবনের কাহিনী নিয়ে আলোয় আঁধার ছোটগল্পটি লেখা।

সন্ধ্যাদেবী গোধূলির ম্লান আলোয় রোয়াকের এক কোণে বসেছিল। সন্তু হাতে তুবড়ি আর তারাবাতি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে বলে, দেখো দেখো ঠাম্মা, বাবা কত তুবড়ি আর তারাবাতি এনেছে আমার জন্য। সন্তুর কথায় সন্ধ্যাদেবী সঙ্গে সঙ্গে মুখ না তুললে সন্তু আবার বলে, ও-ও ঠাম্মা দেখো না। সন্ধ্যাদেবী এবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মলিন হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলে, খুব ভালো হয়েছে দাদুভাই। যাও, মাকে ঠিক করে রেখে দিতে বলো। রাতে বাবা-মার সঙ্গে বাগানে জ্বালাবে। উদাস ভাবে আপন মনে বলতে থাকে সন্ধ্যা দেবী, আজ কালী পূজা। চারিদিকে জ্বলে উঠবে আলোর মালা অথচ আমার ঘরে আলো নেই, শুধুই অন্ধকার। সন্ত্ত ছোট হলেও বুঝতে পারে, ঠাম্মার মন ভালো নেই, তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চায়, ও ঠাম্মা, তুমি কাঁদছো কেন ? মা কত প্রদীপ এনেছে জানো, রাতে প্রদীপ জ্বালাবে না?
---- হ্যাঁ, দাদুভাই, জানি তো। তোর মা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। তোর মা আমার সংসারে এসে আলো দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিল সংসারটা। আর এই অপয়া মেয়েটা, আমার সংসারে এসেই অন্ধকারে ভরে দিল, শুধু বাড়িটা নয়, আমার জীবনটাকেই অন্ধকারময় করে দিলো। অলক্ষ্মী, একেবারে অলক্ষ্মী, অপয়া তা না হলে আর বিয়ের এক বছরের মধ্যেই আমার সোনার ছেলেটাকে ওভাবে চলে যেতে হয়? সন্তু কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠাম্মার দিকে। ঠিক সে সময় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অন্তু। অন্তু সন্ধ্যাদেবীর ছোট ছেলের একমাত্র ছেলে। বয়স মাত্র আড়াই বছর। সে ঠাম্মাকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,ঠাম্মা দেখো না, মাকে কখন থেকে ডাকছি, কিছুতেই বিছানা ছেড়ে ওঠে না। অমনি নাতিকে জড়িয়ে ধরে সন্ধ্যাদেবী মুখ ঝামটা দিয়ে বলতে থাকে, তোর মা তো অপয়া, শুয়ে থাকবে না তো আর কি করবে? শোক, দুঃখ তো আর কিছু নেই তার। ভয় পেয়ে যায় অন্তু। শান্ত স্বরে বলে,মাকে বকছো কেন ঠাম্মা? জানো, মা তো না খেয়ে শুয়ে আছে, শুধু কাঁদে।
----কান্না! মুখ ভেঙিয়ে কথাটা বলে সন্ধ্যাদেবী। ও সব অভিনয় তোর মায়ের। আপন মনে বলতে থাকে কোন কুক্ষণে যে বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছিলাম ওই অপয়াকে, ছেলেটা আমার চলে গেল অকালে।
--- ঠাম্মার মুখে মুখ রেখে অন্ত বলে, ও তুমি বাবার কথা বলছো। বাবা আসবে তো, মা বলেছে।
---- কোথা থেকে আসবে তোর বাবা? ও কি আর আছে?
---- আছে তো। বাবা বাইরে কাজ করে, জানো না? কাজ হয়ে গেলে আসবে, মা বলেছে।
---- মিথ্যে কথা বলেছে তোকে দাদুভাই। তোর বাবা আর কোনোদিন আসবে না। ঠাম্মার কথা শুনে কেমন যেন বোবা হয়ে যায় অন্তু। কিছুক্ষণ পর ঠাম্মাকে আবার বলে, আমিও দাদার মতো তারাবাতি নিবো ঠাম্মা।
--- নিবি তো দাদুভাই। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সন্ত্ত, তার দিকে আঙুল দেখিয়ে দিয়ে সন্ধ্যাদেবী বলে, অ্যাই, ভাইকেও তারাবাতি দিবি কেমন? ভাইয়ের তো বাবা নেই, কে এনে দিবে ওকে? আবার আপন-মনে বলতে থাকে গত বছর আজকের দিনে কতই না আনন্দ ছিল বাড়িতে। গোটা বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছিল সেদিন। সেই ঝলমলে বাড়িটা আমার হঠাৎ ওই অপয়া মেয়েটার জন্য মুহূর্তেই অন্ধকারে ডুবে গেল চিরদিনের জন্য। 'হা ভগবান' বলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সন্ধ্যাদেব ঘরে উঠে যায়। পাশের ঘর থেকে একটি কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ঘরে এসো বাবা, আমার লক্ষ্মী ছেলে,শোনো একটা কথা। মায়ের ডাক শুনে অন্তু দৌড়ে ঘরে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওমা, ওমা তারাবাতি কিনে দাও না?
---- চোখের জল মুছে শিউলি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, দেবো তো বাবা, অনেক তারাবাতি দেবো, দাদার মতো তুমিও জ্বালাবে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তু বলে ওমা বাবা আসবে না?
---- আসবে তো। এখন তোর বাবার অ-নেক কাজ। পরে আসবে বাবা। এবার তুমি, আমি জ্বালাবো কেমন। মজা হবে না বলো?
--- বাবা তো কবে থেকে আসে না, বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে,মা। ছেলের কথায় শিউলির মন আরও খারাপ হয়ে যায়। কেমন করেই সে সত্যিটা ছেলেকে বলবে ভেবে পায় না। শিউলি মনে মনে ভাবে শাশুড়ি মায়ের কথাই ঠিক। আমি সত্যিই অপয়া। তা নাহলে আমার ভাগ্যেই বা এমন ঘটনা ঘটবে কেন? ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিউলি ভাবে  সৌরভ কত খুশি ছিল সেদিন। বাড়ী ভর্তি লোকজন ননদ ননদাই ভাসুরপো--- সবাই মিলে কালী ঠাকুরের সামনে পূজা দেখে আনন্দে টগবগ করতে করতে সব বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। সেই সন্ধ্যায় গোটা বাড়ি টুনি বাল্বের আলোর মালায় ঝলমল করছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল আলোর স্বর্গপুরী। আমাদের আনন্দ দেখে বাবা-মাও খুব আনন্দে ছিলেন---- ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো শিউলির। অন্ত মায়ের দিকে হতচকিত হয়ে বলে, ওমা তুমিও কাঁদছো, ঠাম্মাও কাঁদছে। আমার তারাবাতি কে এনে দেবে ? অমনি শিউলি চোখের জল নিয়েই হেসে বলে, রাগ করে না বাবা, আমি এনে দেবো তো। আমাকে যে আনতেই হবে।
--কেন?
--- তোর বাবা কত দূরে থাকে না, ওকে আলো দেখাতে হবে যে!
---- বাবা আমার মত ছোট নাকি? কৌতুহলী দৃষ্টিতে জানতে চায় অন্তু। আমি তো ছোট তাই তারাবাতি জ্বালাবো, বাবা তো বড়। বড়রা তারাবাতি জ্বালায় বুঝি?
----- অন্তু মায়ের দিকে মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে থাকে উত্তরের অপেক্ষায়।
সন্ধ্যাদেবী সেই যে ঘরে ঢুকলেন আর বের হলেন না। কত করে সেদিন ঠাম্মাকে সন্ত্ত ডাকলো, ও -ও ঠাম্মা, এসো না আমরা বাগানে বাজি ফাটাবো। কিন্তু কিছুতেই তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন না,বৃদ্ধ অমলেশ বাবুও বিছানা ছাড়লেন না। কেবল সন্তু বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে হইহই করে বাজি ফাটালো। শিউলি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তুবড়ি, তারাবাতি, প্রদীপ কিনে আনলো দোকান থেকে। ছোট্ট অন্তু প্রদীপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ওমা ওগুলো কি?
---- ওগুলো প্রদীপ। কালী পুজোর রাতে বাড়িতে জ্বালাতে হয়।
---- তুমি জ্বানাবে?
--- হ্যাঁ বাবা। মায়ের কথা শুনে অন্ত ভারি মজা পায়।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় শিউলি। অন্তর হাতেও জ্বালিয়ে দেয় তারাবাতি। জ্বলন্ত তারাবাতি নিয়ে অন্ত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মজা পায়। কিন্তু শিউলির সৌরভ হারানো পাপড়িগুলি একটি একটি করে দুঃখ- শিশিরের ভারে খসে পড়তে থাকে মাটিতে।  অসহ্য বেদনায় ফেটে যাচ্ছে অন্তর। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে শিউলির। বার বার মনে হতে থাকে তার,সত্যিই সে অপয়া, না হলে সৌরভের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হত না সে কোনোদিন। বিয়ের গত দুই বছরে সৌরভের কোনো রাগ দেখে নি শিউলি। সৌরভকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেছিল সে। হায়রে ভাগ্যবতী, কি নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাস!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উদাসীনভাবে চেয়ে থাকে শিউলি। কোথাও কোনো বিষাদের চিহ্নমাত্র নেই। তার মনে হল পৃথিবীতে আর মত দুঃখী বোধ হয় আর কেউ নেই। ভাবতে-ভাবতে ফিরে আসে ছেলেকে নিয়ে ঘরে। চোখের জল চেপে হাসি মুখে শিউলি ঘুম পাড়ায় অন্তুকে। মনে মনে ঠিক করে এই সময়টা সে হাতছাড়া করবে না কিছুতেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এখন, কেউ কোথাও নেই।
শুধু আপন মনে আলো তার বক্ষ জ্বালিয়ে সবটুকু উজার করে দিচ্ছে পৃথিবীতে নিঃশব্দে। ধীরে ধীরে সে বের হয় ঘর থেকে। এগিয়ে যায় সে পুকুর পাড়ে।
জ্বলন্ত প্রদীপ ভাসাতে ভাসাতে শিউলির মনের আয়নায় ভেসে এলো গতবারের দীপাবলির দিনের নিবিড় ভালোবাসা য় মোড়া সৌরভের সঙ্গে তার আবেগঘন মুহূর্ত-----
শুয়েছিলে তুমি, বললাম---কিগো, উঠবে না?
----হুঁ,একটু পরে--এ।
----আরে পরে কেন?
-----শোনো-ও, কাছে এসো।
---না,না, এখন অনেক কাজ।
---একবার এসোই না লক্ষ্মীটি।
------কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরে-----, তখনই রিতু ঘরে ঢুকতেই কেমন লজ্জায় পড়েছিলে!
----তুমি বুঝি পড়ো নি?
----হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়েছিলা--ম। এবার ওঠো তো লক্ষ্মীটি। রাতের জন্য বাজি,তুবড়ি আনবে তো, নাকি?
----আনবো,আনবো।দেখবো কত বাজি ফাটাতে পারো।
-----আরে মশাই,দেখবেই তো। ছোটোবেলায় কত ফাটিয়েছি!
সেই মুহূর্তেই আনমনা হয়ে ভাবে,তুমি কাছে ছিলে তাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মনে হয়েছিল নিজেকে। গর্ব হচ্ছিল তোমার মত সুন্দর বর আমার বন্ধুরা কেউই পায় নি। গোটা পৃথিবীর সুখ আনন্দ যেন উছলে পড়ছিল আমার মনের উপর দিয়ে। তারপর রাতে অপার আনন্দের আবেগে বাজি ফাটাতেই ঘটলো সেই বিপদ-----
কখন্ যে আঁচলে আগুন ধরেছিল, বুঝতেই পারি নি। আমার পুরো শাড়িতে আগুন লেগে যখন দাউ দাউ করে জ্বলছি তখন তুমি আমাকে ঐ অবস্থায় কোলে নিয়ে 'বাঁচাও' 'বাঁচাও' বলে  চিৎকার করছো-----, আর কিছু মনে নেই। একদিন পর জ্ঞান ফিরে শুনলাম তুমিও নাকি অনেকটা পুড়ে গেছো। তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল কিন্তু নড়বার শক্তি কিম্বা অনুমতি কোনোটাই ছিল না। সপ্তাহ খানেক পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি কিন্তু তুমি চলে গেলে ছেড়ে চিরদিনের মত। কত বলতে, তুমি একটুও আমায় ছেড়ে থাকতে পারো না।
আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার বড় কষ্ট হয়।
অথচ সেই আমাকে ছেড়ে আজ তুমি ক-ত- দূরে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিউলি।

তুমি নেই হয় না বিশ্বাস। তুমি আছো আমার চারপাশে কোথাও না কোথাও। তুমি অন্ধকার বড় ভয় পেতে। আজ চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঝলমল করছে পৃথিবী। তুমি অন্ধকারে ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে আর আমি আলোয় থাকবো এও কি কখনো হয়,বলো? এই নাও, আলো দিলাম তোমায়। এই আলো নিয়ে ঝলমল করে জ্বলে ওঠো তুমি, প্রাণভরে একবার দেখি তোমায় --- পুকুরের জলে তখন ভেসে ভেসে দু'টি প্রদীপ মুখোমুখি জ্বলছে প্রেমালোর নিবিড়তায়।

তাং- ১০-১১-২০২০


No comments:

Post a Comment