Society in Rabindranath Tagore's Short Story - Khushi Sarkar - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

22 Oct 2020

Society in Rabindranath Tagore's Short Story - Khushi Sarkar

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে সমাজ প্রাবন্ধিক খুশী সরকার
 

Society In Rabindranath Tagore's Short Story essayist Khushi Sarkar.
 
Society is inseparable with literature. Literary creation deals with worldly and social life, so the inevitable shadow of the living mind and direct life falls in literature. Readers and writers are both social human beings so social materials simultaneously move their literary and social minds. And the reality associated with this social consciousness, according to Rabindranath, does not mean reality. The story of the tiger, who wants soap to remove the black spots on his skin, is true, and he also says that when a person or object appears with its character, it is real, so real is the manifestation of the nature of life.
 
প্রবন্ধ -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে সমাজ।


সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের অবিচ্ছেদ্য। লৌকিক ও সামাজিক জীবনকে নিয়ে সাহিত্যিক সৃষ্টি কলা চলে তাই সজীব মন ও প্রত্যক্ষ জীবনের অনিবার্য ছায়া সাহিত্যের মধ্যে পড়ে। পাঠক লেখক উভয়েই সামাজিক মানুষ তাই সামাজিক উপকরণগুলি যুগপৎ তাদের সাহিত্যিক ও সামাজিক মনকে নাড়া দেয়। আর এই সমাজ চেতনার সঙ্গে যুক্ত বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথের মতে বাস্তবতার অর্থ "এই নয় যা সদা সর্বদা হয়ে থাকে যুক্তিসংগত। যে কোনো রূপ নিয়ে যা কষ্ট করে চেতনাকে স্পর্শ করে তাই বাস্তব। যে রূপ মনে ঔৎসুক্য জাগায়, যা শূন্যতা দূর করে তাই হল বাস্তব শিশু কাছে খ্যাপা বাঘের কাহিনী, যে গায়ের কালো দাগ দূর করবার জন্য সাবান চায়,তা সত্য। তিনি আর‌ও বলেছেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি বা বস্তু তার বিশিষ্টতা নিয়ে দেখা দেয় সে হল বাস্তব। সুতরাং বাস্তব হল জীবন স্বরূপের প্রকাশ।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের রচনা দুটি ধারা। একটি মানুষের সুখ-দুঃখ বিরহ মিলন পূর্ণ ভালোবাসা অন্যটি সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা। এই দুই ধারার মধ্যে মানুষের সুখ-দুঃখ বিরহ মিলন পূর্ণ ভালবাসার প্রতি ঝোঁক বেশি তাই তিনি করি ও কোমল কাব্যে স্পষ্টতই জানালেন, " মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই কবি তখনো জীবনকে দেখেছেন দূর থেকে। নাগরিক জীবনের ধনী পরিবারের উচ্চ মঞ্চে তিনি নির্বাসিত। কিন্তু ১৮৯১ সালে সোনার তরী পর্বে কবি জীবনের সেই দূরত্বের বাঁধা গেল ঘুঁচে। কবি মানুষ ও প্রকৃতির মিলন প্রাঙ্গণে এসে মুক্তি পেলেন। রবীন্দ্রনাথের এই মানবমুক্তির বিবরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়--" বিলাত হইতে ফিরিবার কয়েক মাসের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথকে কার্যভার গ্রহণ করিয়া উত্তরবঙ্গে যাত্রা করিতে হইল।... রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে অন্তরঙ্গভাবে জানিয়েছিলেন। মানুষ কি তেমন নিবিড় ভাবে জানাতে সুযোগ লাভ করেন নাই। জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনা করিতে আসিয়া বাংলার অন্তর সঙ্গে তার যোগ হ‌ইল-মানুষকে তিনি পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখিলেন।
কবি নিজেও তাঁর সোনার তরী কাব্যের ভূমিকায় লিখলেন,---" বাংলা দেশের নদীতে নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর নূতনত্ব, চলন্ত বৈচিত্র্যের নতুনত্ব। এইখানে নির্জন সৃজনের নিত্য সঙ্গম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখ-দুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবন যাত্রার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁছাচ্ছিল আমার হৃদয়ে।" উত্তর বঙ্গের শিলাইদহ সাহজাদপুর পতিসরে পদ্মা-- গরাই-- নাগর চলন বিলের তীরে তীরে কবি দেখলেন পরিচিত জীবনের স্রোত।"......... গুটিকতক খড়ো ঘর, কতকগুলি চালশূণ্য মাটির দেয়াল, দুটো একটা খড়ের স্তুপ কুল গাছ আম গাছ বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড় গোটা তিনেক ছাগল চরছে, গোটা কতক উলঙ্গ ছেলে মেয়ে, নদী পর্যন্ত একটা গড়ানে কাঁচা ঘাট সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে,কেউ বাসন মাজছে, কোনো কোনো লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসি কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে।"
    ‌                                   
কখনো এখানকার পোস্টমাস্টার এসে গল্প নানা গল্প জুড়ে দেয়, কখনো চোখে পড়ে গোলগাল হাতে বালা পরা উজ্জ্বল সরল মুখশ্রী মেয়েটিকে নৌকায় অনেক চেষ্টা হচ্ছে, আবার কখনো দেখতে পান ---একটা খ্যাপাটে খেলে সারা গ্রাম দুষ্টুমির ছুটে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ একদিন চলে যেতে হল শহরে তার মামার কাছে।" এখানেই কবির পরিচয় হলো বিচিত্র লোকের সঙ্গে। এদের কেউ মাঝি, কেউ বাউল, কেউ ভিখারী, কেউ স্কুলের শিক্ষক, কেউ গ্রামের পোস্টমাস্টার, কেউ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, কেউ দরিদ্র চাষী। জমিদারবাবুটির কাছে এরা তাদের সুখ-দুঃখের কথা জানায়। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এইটুকু চোখে দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে ... আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখনো ঘটে নি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।"
কবির সম্মুখে এখন গল্পের অনিঃশেষ উপকরণ। কাহিনী বানিয়ে তুলতে হচ্ছে না গল্প জন্ম দিতে লাগলো জীবনের নিত্য অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলা সাহিত্যে অখ্যাত অজ্ঞাত মানুষের এই প্রথম পদার্পণ।
"ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা"-- এইসব গল্পের বিষয়। কবি বলেন, আমি যে ছোট ছোট গল্পগুলো লিখেছি, বাঙালি সমাজের বাস্তব জীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে।"

চার খণ্ডে সমাপ্ত রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের প্রথম খন্ডের রচনা গুলির মধ্যে ও দালিয়া ইতিহাসাশ্রিত, একটা আষাঢ়ে গল্প, রীতিমত নভেল, জয় পরাজয়, অসম্ভব কথা ও একটি পুরাতন গল্প, কল্পকাহিনী রূপকথা অথবা উপকথা।
দ্বিতীয় খন্ডের রচনা গুলির মধ্যে ইচ্ছাপূরণ, উদ্ধার, উলুখড়ের বিপদ, দুর্বুদ্ধি, প্রতিবাদিনী, অন্তর ও বাহির,শুভদৃষ্টি, অধ্যাপক প্রভৃতি গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রাণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। তৃতীয় খন্ডের চিত্রকর, চোরাই, ধন, সংস্কার -- সমাজের তেমন ছায়াপাত ঘটে নি। এবং চতুর্থ খন্ডের রবিবার ল্যাবরেটরি ও শেষকথা ব্যতীত অন্য  গল্প গুলি রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য ছোটগল্পের পাশে নিতান্তই ম্লান। কিন্তু এই তিনটি গল্পেই রবীন্দ্র সাহিত্যের একটি নূতন দিক উন্মোচিত হয়েছে যা নারীত্বের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় সমুজ্জ্বল। এই গল্পগুলি বাদে বাকি সব গল্প গুলিতেই আছে বাস্তব সামাজিক মানুষের পরিচয়।

গল্পগুচ্ছ গ্রামবাংলার অতিপরিচিত বাস্তব জীবনের দর্পণ। আর এই সমাজের প্রতিনিধি স্বরূপ অসংখ্য বাস্তব চরিত্রের অ্যালবাম। রবীন্দ্রনাথ গল্পগুচ্ছে যে সমাজের বর্ণনা করেছেন তা তিন স্তরে বিভক্ত।
প্রথম স্তরে জমিদার তথা উচ্চবিত্ত সমাজ দ্বিতীয় স্তরে মধ্যবিত্ত সমাজ ও তৃতীয় স্তরে নিম্নবিত্ত সমাজ।
এই তিন স্তরে সমাজের অসংখ্য চরিত্র, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তৎকালীন সমাজের রীতি-নীতি বিবাহ সমস্যা, দ্বন্দ্ব নৈতিক ভ্রষ্টতা, সংস্কার, সামাজিক ক্রিয়া কলাপ, ও নানাবিধ অনুষ্ঠান প্রভৃতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। উচ্চবিত্ত সমাজের চরিত্রের মধ্যে আছে উদার হৃদয় ধর্মপ্রাণ অথচ স্খলিত চরিত্র কৃষ্ণগোপাল, হৃদয়হীন আইন ও কর্তব্য সচেতন নব্য শিক্ষিত চরিত্র জমিদার বিপিনবিহারী, বিচিত্র ভ্রাতৃপ্রীতিতে সমুজ্জ্বল চরিত্র জমিদার শশিভূষণ ও রাধামুকুন্দ, মাটির নিচে সঞ্চিত ধনও রক্ষায় নিজ নাতিকে যক্ষ রেখেছে জেনে উন্মত্ত হাহাকারে ভগ্নহৃদয় কৃপণবৃদ্ধ যজ্ঞনাথ, সংস্কারাচ্ছন্ন অপ্রাকৃতে বিশ্বাসী জমিদার শারদা শংকর, বিগত শ্রী জমিদারির সৌন্দর্য ও বংশগৌরব রক্ষায় আপ্রাণ সচেষ্ট জমিদার ঠাকুরদা, উচ্ছাসপ্রবণ ও আবেগে অগভীর প্রেমে দুর্বল চিত্ত জমিদার দক্ষিণাচরণ। 'পয়লা নম্বর' এ রমণীর অব্যক্ত গভীর দুঃখে সহানুভূতিপ্রবণ ও পৌরুষময় আত্মনিবেদক জমিদার সিতাংশু মেটলি -- এই রকম কয়েকজন উচ্চবিত্ত জমিদার চরিত্র ব্যতীত অধিকাংশ গল্পে মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন ও চরিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। দেনা পাওনা গল্পের আছে প্রতিশ্রুত পণদানে অসমর্থ অসহায় হৃদয় যন্ত্রণায় বিখ্যাত রামসুন্দর, স্ত্রীর সোনার স্বপ্নে বিপর্যস্ত সংসার ত্যাগী নিরীহ বৈদ্যনাথ, স্বামীর প্রতিষ্ঠা স্বপ্নে আত্মনিবেদিতা পতিব্রতা দাক্ষায়ণী, আপন স্ত্রী-পুত্রের স্বার্থ বিস্মৃত সত্য সাক্ষ্যদাতা রামকানাই, লেখক খ্যাতি ও ঐশ্বর্য লাভের স্বপ্নে বিভোর সর্বস্বান্ত তারাপ্রসন্ন ও সম্পাদক, কটুবাক্যে নিপুণা নারী ফটিকের মামি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যর্থ পুরুষ সুরবালার স্বামী, আমৃত্যু প্রেমের স্মৃতি রক্ষায় উপদ্রুত ও বঞ্চিত পতিতা ক্ষীরোদা, প্রকৃতির সহজ ও মুক্ত পরিবেশে লালিত  সমাজের পারিবারিক প্রথার বলি হৈমন্তী, স্বামী প্রেমের নির্ভরতায় আত্মনিবেদনকারী কুমুদিনী, প্রভৃতি মধ্যবিত্ত সমাজের চরিত্র। এই চরিত্র গুলির মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজ নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছে।

সংখ্যায় কম হলেও গল্পগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নিম্নবিত্ত সমাজের ছবিও এঁকেছেন। প্রভুর সন্তান হারানোয় হতবুদ্ধি এবং অসামান্য আত্মত্যাগে সমুজ্জ্বল রাইচরণ, আপন অধিকার রক্ষায় চিত্র সংকল্প দুর্বিনীত প্রজা অছিমুদ্দি, সারাদিনের শান্তি ও লাঞ্ছনা আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্রোধোন্মত্ত স্ত্রী হত্যাকারী দুখিরাম, পিপাসার্ত হৃদয়ের বেদনাবাহী প্রবাসী কাবুলিওয়ালা রহমৎ, পোস্টমাস্টারের সেবা কার্য আত্মনিবেদিত অনাথা রতন প্রভৃতি চরিত্রগুলি নিম্নবিত্ত সমাজের চরিত্র।

তাছাড়া কিছু বালক-বালিকা তাদের আনন্দ-বেদনার দাবি নিয়ে ছোটগল্পে আত্মপ্রকাশ করেছে আপন আনন্দ ভূমি হতে নির্বাসিত দুরন্ত বালক ফটিক শিবনাথ পন্ডিতের পরিহাস জর্জর নিরীহ বালক আশু কাবুলিওয়ালা গল্পের অভ্যাসের জড়ত্বকে আঘাতকারী চার বছরের মিনি, পরের দুঃখে কাতর কৌতূহলী বালিকা শশী, কাকিমা প্রিয় পিপাসার্ত অসুস্থ বালক খোকা, মুক্ত বিহঙ্গীর স্বাধীন আকাশ থেকে বিবাহবন্ধনে বন্দিনী দুরন্ত বালিকা মৃন্ময়ী, প্রকৃতি কোল থেকে নির্বাসিতা বোবা মেয়ে সুভা, লেখার আনন্দলোক থেকে বঞ্চিতা বালিকা উমা, স্নেহের আশ্রয় রিক্তা নিঃসঙ্গ বেদনার অশ্রুতে উজ্জল রতন -- সবাই সেই সমাজের প্রতিনিধি। সব বালক-বালিকা কবির সহানুভূতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এইভাবে কবি তৎকালীন সমাজের চরিত্র গুলির মধ্য দিয়ে সেই সমাজের বাস্তব রূপ অঙ্কন করেছেন।

এইসব বিভিন্ন চরিত্র গুলির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের জীবন্ত আলেখ্য রচনা করেছেন। 'সমস্যাপূরণ' গল্পে বেহিসাবি উদার জমিদার কৃষ্ণ গোপাল খুব ধার্মিক ব্যক্তি তিনি অনেক জমি এমনিতেই অনেক কে দান করে দিয়েছেন। প্রজারা সবাই তাকে মান্য করত এবং জমিদার ও প্রজার মধ্যে দান প্রতিদান সম্পর্ক ছিল কিন্তু কৃষ্ণ গোপাল কাশি চলে যাওয়ার পর জমিদারের সঙ্গে কৃষ্ণ গোপালের পুত্র বিপিনবিহারীর মতপার্থক্য দেখা দিল। সবাই বিপিনবিহারী বশ্যতা স্বীকার করলেও একজন কেবল করল না সে হলো বিধবা যবন মির্জা বিবির পুত্র অছিমুদ্দি। সে আপন অধিকারের এক তিল ছাড়তে রাজি নয়। হলে উভয় পক্ষে যখন সম্পত্তি নিয়ে মামলা হল। মামলার শেষ রায়ের দিন জানা গেল কৃষ্ণ গোপালের পুত্র অছিমুদ্দি। ধর্মপ্রাণ জমিদার কৃষ্ণ গোপালের মহৎ চরিত্রের অন্তরালে এইযে ভ্রষ্টাচার তৎকালীন উচ্চবিত্ত সমাজের জমিদারের চরিত্রের পরিচায়ক।

অন্যদিকে নয়নজোরের জমিদার ঠাকুরদা। আজ ঠাকুরদা পূর্ব জমিদারের বংশগৌরব রক্ষায় সচেষ্ট। সে অতিদরিদ্র অথচ বিগতশ্রী জমিদারির পূর্ব স্মৃতি রোমন্থন করে দিন কাটায়। ধ্বংসোন্মুখ জমিদারের বর্ণনা লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। ঠাকুরদা যে সেই পূর্ব জমিদারের‌ই বংশ ---এই সংস্কারে সে আচ্ছন্ন এইরূপ একটি মানসিকতাসম্পন্ন জমিদার শ্রেণীর চরিত্রের পরিচায়ক।

'দান প্রতিদান' গল্পে বিচিত্র ভ্রাতৃস্নেহে সমুজ্জ্বল জমিদার শশীভূষণ ও রাধা মুকুন্দ তারা সহোদর ভাই নয়। একেবারে গ্রাম্য সম্পর্কে ভাই কিন্তু দুই ব‌উ ব্রজসুন্দরী ও রাসমণি। প্রায় ঈর্ষাবশতঃ ঝগড়া করত। এই অশান্তির কারণেই রাধা মুকুন্দ জমিদারি প্রেরিত খাজনা ডাকাতে লুট করেছে বলে জমিদারি নিলামে যায়। এই দুই ভাইয়ের মনোমালিন্য হয় এবং সেই দুঃখে শশীভূষণ মৃত্যুমুখে পতিত হয় কিন্তু শশীভূষণ এর মৃত্যুর পূর্বে রাধা মুকুন্দ সব কপটতা স্বীকার করে। তৎকালীন একান্নবর্তী পরিবারের বউ রাই যে ভাতৃ বন্ধন ছিন্ন করতো তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ব্রযো সুন্দরী ও রাসমণি। এতে জমিদারের খাজনা আদায়ের স্বরূপও প্রকাশ পেয়েছে। নতুন ব্যবসায়ী জমিদারি কার্যে অনভিজ্ঞ থাকায় রাধা মুকুন্দ লাঠিয়াল নিয়ে প্রজাদের উপর অত্যাচার করে খাজনা আদায় করেছে। 'শাস্তি' গল্পেও জমিদারে অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। যখন বাইরে সকল প্রজা অথাৎ দরিদ্র জনসাধারণ জলি ধান কাটতে ব্যস্ত তখন জমিদারের পেয়ারা দুখিরাম ও ছিদাম রুইকে জোর করে কাছারী চাল মেরামত করতে ধরে নিয়ে গেছে। সারাদিন তারা বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেছে কিন্তু তাদের কিছু খেতে দেয়নি। সারাদিন পরিশ্রম করে অনাহারে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পেয়ে তারা অনেক কটু বাক্য ও গালিগালাজ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে--- এই ছিল জমিদারদের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক।

তাছাড়া জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে গ্রাম্য জমিদারদের মধ্যে দলাদলি, লাঠালাঠি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হত। 'সম্পাদক' গল্পে জাহিরগ্রাম ও আহিরগ্রাম জমিদারদ্বয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মুচলেকা দিয়ে দলাদলি লাঠালাঠি ছেড়ে পত্রিকা মাধ্যমে কুৎসা যুদ্ধে অবতীর্ণ। এনাৎশাহী পরগনার জমিদার শশীভূষণের চালান দেওয়া খাজনার টাকা পথে ডাকাতের লুঠ করলে লাটের তার জমিদারি নিলাম হয়। সমস্যাপূরণ গল্পেও বিপিনবিহারী ও  অছিমুদ্দির মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। এই চিত্র ছাড়াও সম্পন্ন গৃহস্থের বা জোতদারের চিত্র‌ও আছে। স্বর্ণমৃগ গল্পে দাদা শিবনাথ ছোটভাই মহেশচন্দ্রকে স্নেহ বাক্যে ভুলিয়ে তার বিষয় সম্পত্তি আত্মসাৎ করে। অন্যদিকে ব্যবধান গল্পে হিমাংশু ও বনমালী আবাল্যবন্ধু। কিন্তু সামান্য একটা পাতি লেবুর গাছের অধিকার নিয়ে দুই বন্ধুর পিতা দই হরো চন্দ্র ও গোপীচন্দ্রের মধ্যে মামলা হ‌ওয়ায় এই দুই অভিন্নহৃদয় বালকের মধ্যে ব্যবধান রচিত হয়।

'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা' গল্পে দাদা গুরু চরণ এর কাছ থেকে বিষয়-সম্পত্তি হাতকড়ার বিস্তর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বান রামকানাই তা গ্রহণ করে নি। এর জন্য সে স্ত্রী পুত্রের কাছে অনেক অপমানিত হয়েছে। এমনকি কাশিতে গিয়ে কিছুকাল বাস করতে হয়েছে। নবদ্দীপ উইল জাল করে জ্যাঠাইমার বড়দা সুন্দরীকে ঠকাতে চাই আদালতে মামলা হয়। যখন উভয়ে আদালতে পরস্পরের নামে উইল চুরিদারের অভিযোগ আনে তখন রামকানাই সত্য সাক্ষ্য দিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করে। মামলা মোকদ্দমা ব্যাপারে গ্রামে একজন প্রধান প্রধান মন্ত্রী থাকে। 'শাস্তি' গল্পে রামলোচন চক্রবর্তী এই ব্যাপারে প্রমাণ দেখিয়েছে। রাধার খুনের হত্যাকারীর সংশয় নিয়ে যখন ছিদাম রামলোচন চক্রবর্তীর কাছে পরামর্শ চেয়েছে তখন তিনি অতি সুন্দর ভাবে মামলাটিকে সাজিয়ে দিয়েছেন এদের মামলা-মোকদ্দমার চিত্র ছাড়াও দরিদ্র প্রজাদের মামলা-মোকদ্দমার প্রভাবের স্বরূপটি ফুটে উঠেছে। সমস্যাপূরণ গল্পে আকণ্ঠ দেনায় নিমগ্ন হয়ে আপন অধিকারের প্রতিষ্ঠায় অছিমুদ্দি ফৌজদারি ও দেওয়ানী জেলা আদালত হাইকোর্ট করে যখন সর্বস্বান্ত মহাজন' তখন সময় বুঝে ডিক্রি জারি করে। 'রাসমনির ছেলে' গল্পেও মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে উইল চুরির ব্যাপারে। এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর সমাজে গ্রাম্য মামলা-মোকদ্দমা চিত্রগুলি রবীন্দ্রনাথ অতি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, যেগুলি তৎকালীন সমাজের‌ই পরিচয় বহন করে।

বিবাহে পণপ্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধির শিকার হয়েছে অনেক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। দেনা পাওনা গল্পের পণপ্রথার চিত্রটি অতি বাস্তব সম্মত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সিওসি অথচ পণের টাকা দিতে অসমর্থ পিতা রামসুন্দর বন্ধকী বিক্রয় এবং বিস্তর সুদে টাকা ধার করেও যখন বর পক্ষের পণের টাকা জোগাড় করতে পারলো না কাকু রায়বাহাদুরের ঘোষণা, "টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না, বর সহসা পিতৃদেবের অবাধ্য হওয়া একেবারে নিরানন্দ ভাবে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হল কিন্তু ব্যাটারি নিরুপমা আর কোনোদিন বাপের বাড়ি ফিরতে পারলো না। অনাদরে, অত্যাচারে প্রায় বিশীর্ণ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। খুব ধোন করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন হতেই, "এবার বিশ হাজার পণে পুত্রের জন্য পুনর্বিবাহের সম্পর্ক পাকা হ‌ইল।" এই পণ প্রথার শিকার হয়েছে 'অপরিচিতা' গল্পে কল্যাণী। বহু বাদানুবাদ বিরূপ মন্তব্য ও তথ্য পাঠানোর পরে যখন কল্যাণেই বিবাহ ঠিক হলো তখন কেবল মাত্র বরপক্ষের সংকীর্ণ মনোভাবের জন্য কল্যাণী চিরকুমারী ব্রত করল কন্যার পিতা শম্ভুনাথ সেন কর্তৃক প্রদত্ত গয়নার উৎকৃষ্টতা যখন  যাচাই করতে চেয়েছে তখন শম্ভুনাথ বাবুর ধীরকন্ঠে প্রতিবাদ," আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব একথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।" এই অপমানের কল্যাণীও চিরকুমারী ব্রত গ্রহণ করল।

পাত্র-পাত্রী গল্পেও বিবাহ সমস্যার কথা আছে অভিভাবকের মধ্যস্থতায় তখন বিয়ে হতো তাতে পাত্র-পাত্রীর নিজস্ব মতামতের মূল্য ছিল না। এর শিকার হয়েছে কাশীশ্বরী ও সনৎ কুমার। পিতার মতানুযায়ী ধোনির কন্যাকে বিবাহ না করায় সনৎকুমার সারাজীবন অবিবাহিত‌ই থেকে গেল। 'স্বর্ণমৃগ' গল্পে সপ্ত কন্যাদায়গ্রস্ত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের জ্যেষ্ঠ কন্যার সঙ্গে মহেশ চন্দ্র নিজ পুত্রের বিবাহ দেন। কিন্তু অপরপক্ষে শিবলাল বাবু বহু অনুসন্ধান করে ধোনির কন্যার সঙ্গে  একমাত্র পুত্রের বিবাহ দেন কারণ যদি ধনীর বিষয়সম্পত্তি হাত করতে পারেন। সম্পাদক গল্পে প্রভার পিতা সম্পাদক মশাই জানেন বেশি খরচ না করলে ভালো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দেওয়া যাবে না। কঙ্কাল গল্পের শশী শেখরও বিবাহে বরপণ পাবে বারো হাজার। মধ্যবিত্ত সমাজের লেখক বাস্তবসম্মতভাবে অঙ্কন করেছেন।

এরই বিপরীতে দেখতে পাই ধন সঞ্চায়। 'সম্পত্তি সমর্পণ' গল্পের বৃদ্ধ যজ্ঞনাথ কুন্ডু  মাটির নিচে তার সঞ্চিত অর্থ রক্ষার জন্য যক্ষ রাখে। মাটির নিচে ধন সঞ্চিত রাখবার জন্য জগনাথ কুন্ডু পুত্রবধূর সুচিকিৎসা করে নি এবং পুত্রকে গৃহ ছাড়া করেছে। আর সঞ্চিত অর্থ রক্ষার জন্য আপন না থেকেই যক্ষ রেখেছে জেনে বৃদ্ধ হাহাকারে উন্মত্ত হয়েছে। সমাজের একদিকে অর্থনৈতিক হাহাকার আর একদিকে ধন সঞ্চায় - এসবকিছুই লেখকের দৃষ্টি এড়ায় নি। আবার গ্রামে কোনো ব্যাপারে পুলিশ আসলে অপরাধী ও নিরপরাধী সবাই আতঙ্কিত হয়।

 বাল্যবিবাহ এই সমাজের প্রচলিত বিধি। 'একরাত্রি' গল্পের নায়িকার এগারো বছর বয়সে বিবাহ হয়। আর 'খাতা' গল্পের উমার বিবাহ হয় নয় বছর বয়সে প্যারীমোহনের সঙ্গে। 'দৃষ্টিদান' গল্পে কুমুদিনীও বালো বিবাহিতা, চার বছর বয়সে বিবাহ হয় মিনির 'কাবুলিওয়ালা' গল্পে। এইসব বালিকাদের যৌবন পূরণের পূর্বেই বিবাহ হবার ফলে সামাজিক নানা আচার-অনুষ্ঠান প্রথার সংস্কার প্রভৃতির দ্বারা নিষ্পেষিত হয়ে অকালে বিনষ্ট হয়ে যায়। এর ফল স্বরূপ সমাজে ছিল বহু বিবাহ বা সতীন প্রথা। নিরুপমার মৃত্যুর পর তার স্বামী বিশ হাজার টাকা পণে নতুন বিবাহ করেছে। মধ্যবর্তিনী গল্পের সুন্দরী নিঃসন্তান হ‌ওয়ায় হরসুন্দরী নিজেই উৎসাহ দিয়ে শৈলবালার সঙ্গে স্বামীর বিবাহ দিয়েছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় বিবাহের জন্য তাদের দাম্পত্য জীবনে নেমে এসেছে অশান্তির ঝড় যার শিকার হয়েছে শৈলবালা। মুক্তির উপায় গল্পেও মাখনলালের দুটি স্ত্রী এবং এই দুই স্ত্রীর জালাই শেষ পর্যন্ত মাখনলাল গৃহত্যাগ করেছে। দৃষ্টিদান গল্পে বালো বিবাহিতা কুমুদিনী একান্তভাবেই স্বামীর উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও স্বামী হিমাঙ্গিনিকে বিয়ে করতে গেছে। তবুও স্বামী প্রানা কুমুদিনী স্বামীর প্রতি কোন লোভ খারাপ আচরণ না করে কেবল সত্য পথে ফিরে আসতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে। সুভার স্বামীও চক্ষুকর্ণ পরীক্ষার দ্বারা ভাষা বিশিষ্ট নতুন বিবাহ করে এনেছে। বড়দা সুন্দরীও গুরু চরণের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। এছাড়াও রয়েছে নিন্দা শাশুড়ির জ্বালা ও একঘরে করার নিয়ম। তাই উপযুক্ত বয়সে পিতা-মাতা বোবা মেয়ে সুভার বিয়ে দিতে না পারায় লোকে নিন্দা করতে আরম্ভ করে এমনকি তাদের একঘরে করার মতলব ফাঁদে। বালিকা বধূ ওমা সবসময়ই ননদের নজরবন্দী। দুরন্ত মৃন্ময়ীর মুক্ত পক্ষ শাশুড়ির সামনে ছিন্ন। নিরুপমাও শাশুড়ির জ্বালা যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পায় নি। হালদার গোষ্ঠী বড় ছেলে বনওয়ারী লাল সামাজিক প্রথার জন্য গৃহ ত্যাগ করেছে। হৈমন্তী শাশুড়ির কাছে নির্যাতিত হয়েছে। মুক্তির উপায় গল্পেও শাশুড়ির জ্বালা-যন্ত্রণা কথা আছে। শুধু শাশুড়িরাই নয়, শ্বশুর‌ও সমাজের বাইরে নয়। তাই কঙ্কাল গল্পের নায়িকার শৈশব বিবাহের দু'মাসের মধ্যেই স্বামীর মৃত্যু ঘটলে শশুরের বিচারে সেবিস কন্যারূপে প্রতিপন্ন হয়। হৈমন্তীর পিতার সঞ্চিত অর্থ না থাকায় সেও শশুরের অবজ্ঞার পাত্রী হয়ে দাঁড়ায়।

 'ঘাটের কথা' ও ত্যাগ গল্পের নায়িকা দুজনেই বাল্যবিধবা আর দুজনের নামও কুসুম। ঘাটের কথার কুসুম বিবাহের এক বছরের মধ্যে বিধবা হয়। উপযুক্ত সময়ে তার মধ্যে সন্ন্যাস এর সংস্পর্শে প্রেমের জাগরন ঘটলে সে জলে আত্মাহুতি দেয়। কঙ্কাল গল্পের নায়িকা বানিয়ে প্রদান করে প্রেমিক কে হত্যা করে এবং নিজেও আত্মঘাতী হয়। আর ত্যাগের কুসুম হেমন্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সমাজ ও শ্বশুর প্রদত্ত বহিষ্কার দন্ড লাভ করে। 24 বছরের মহামায়া কুলীন ঘরের কুমারী উপযুক্ত বয়সে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় নি। সাধ্যাতীত ব্যয় ব্যতীত অনুরূপ কুল সম্পন্ন পাত্র জোটে না। দাদা রাজীব লোচনের সে সাধ্য ছিল না, সুতরাং গঙ্গাতীরে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়ে পুরো রক্ষা পেল। কিন্তু বিবাহের পরদিনই মহামায়া বিধবা হল এবং একি সুতাই মহামায়া হাত-পা বাঁধা হয়ে স্বামীর সহমৃতা হয়। প্রায়শ্চিত্ত গল্পে কন্যা বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার সামির নব ঘর করায় পিতা প্যারিশংকর সমাজে এক ঘরে হয়। সে জাত ছেড়ে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেও নিষ্কৃতি পেল না সেই অপরাধে তার পুত্রের বিবাহ ভঙ্গ হলো। হরিশংকর সুকৌশলে হেমন্তের সঙ্গে বিধবার কায়স্থ কন্যা কুসুমের সঙ্গে বিবাহ ঘটে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। প্রায় প্রত্যেক গল্পে এইভাবে বিধবার চিত্র তৎকালীন সমাজ পরিবেশ লেখক উপস্থাপিত করেছেন।

এই সমাজ ভ্রাতৃপ্রেমেও সমুজ্জ্বল। জমিদার শশীভূষণ গ্রাম্য সম্পর্কে ভাই হলেও তাদের ভ্রাতৃ প্রেম গভীর। ভাই না হলেও আবাল্য বন্ধু বনমালী ও হিমাংশু মালী অভিন্ন হৃদয়। এর পাশাপাশি জায়গায় কলহ ও কোন্দলের দৃশ্য দেখা যায়। বড় বা সুন্দরী ও রাসমণি দুই জায়ের কলহ একান্নবর্তী সমাজে ভ্রাতৃ বন্ধন শিথিল করেছে। শাস্তি গল্পের দুখিরাম যেমন ভ্রাতৃস্নেহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তেমনি রাধা ও চন্দনার জায়গায় কলহ পরিবারের শান্তি বিঘ্নিত করেছে। দরজাল নারীর প্রতিনিধি ফটিকের মামি। মামির মমতাহীন ব্যবহার ফটিককে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে।

চাকুরীজীবী কিছু সমাজ প্রতিনিধিও আছে। রতনের প্রভু উলাপুর গ্রামের পোস্টমাস্টার, ভৃত্য রাইচরণের প্রভু অনুকূল বাবু মুন্সেফ, সুরবালার স্বামী উকিল, 'একরাত্রি'র নায়ক স্কুল মাস্টার, শিবনাথ বাবু স্কুলের পন্ডিত মশাই, নিবারণচন্দ্র সওদাগরী অফিসের কেরানী, কুমুদিনীর স্বামী ডাক্তার, মৃন্ময়ীর পিতা কুশীগঞ্জ ঘাটের স্টিমার কোম্পানীর কেরানী, 'কঙ্কাল' এর নায়ক শশিশেখর ডাক্তার, কাবুলিওয়ালা রহমৎ কুসীদজীবী, 'ত্যাগ' এর কুসুমের স্বামী ব্যারিস্টার, তারাপ্রসন্ন,উমারস্বামী প্যারীমোহন, উমার দাদা গোবিন্দলাল, এবং প্রভার বাবা-- এরা সবাই লেখক। দুখিরাম, ছিদাম, দিনমজুর রাইচরণ, গৃহভৃত্য, রতন কাজের মেয়ে-- এইভাবে এরা নানা কর্মসূত্রে জড়িত।

এদের মধ্যে আছে কিছু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। 'সমাপ্তি'র অপূর্ব বি.এ পাস। তার কথায়, "মেয়ে না দেখিয়া বিবাহ করিতে পারিব না"। তারা আধুনিক মানসিকতার জন্যই সে মৃন্ময়ীকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায়। নিরুপমার স্বামীও শিক্ষিত ব্যক্তি। তাই সে পিতৃদেবের কথার অবাধ্য হয়ে বলে, "বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইবো"। 'ত্যাগ' এর বালবিধবা কুসুমকে হেমন্ত বিবাহ করতে চাইলে পিতা তাকে অসবর্ণ বিবাহের কথা বলে, তাতে হেমন্ত প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, "আমি জাত মানি না"। জাত না মানার প্রশ্নটি নিতান্তই আধুনিক কালের। সেই সমাজের যে পরিবর্তন আসন্ন, ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চরিত্র গুলির মধ্য দিয়ে তার‌ই আভাস দিয়েছেন।

সমাজের এই সব দিক ছাড়াও এসেছে জায়ে জায়ে কোন্দল, ঈর্ষা। 'শাস্তি' গল্পে রাধা ও চন্দরার কোন্দল একদিন সংসারে অশান্তি ও বিচ্ছেদ ডেকে আনে। এইরূপ দুই জায়ের কলহের চিত্র আছে 'দান প্রতিদান' গল্পে। শশীভূষণের  স্ত্রী ব্রজসুন্দরী ও রাধা মুকুন্দের স্ত্রী রাসমণি-- উভয়ই পরস্পর কলহ ও ঈর্ষায় সংসারে ফাটল ধরায়। বাঙালি সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের মূলসূত্র ধরতে চেয়েছেন।

এই চিত্রের পাশাপাশি আছে ভ্রাতৃপ্রেমের চিত্র। শাস্তি গল্পে দুখিরাম ও ছিদাম, 'দান প্রতিদান' গল্পে শশিশেখর ও রাধা মুকুন্দ, এবং ব্যব

দাক্ষায়নীর মতো পতিব্রতা নারী, মোক্ষদাসুন্দরীর মতো মুখরা নারী, কন্যাদায়গ্রস্ত রামসুন্দর, পতিতা ক্ষীরোদা ছাড়াও গ্রাম্য দলাদলি, লাঠালাঠি, ষড়যন্ত্র, কুসংস্কার, নারীর অন্তঃপুরচারিতা, সামাজিক রীতিনীতি প্রথা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য-- সব‌ই সেই সমাজের বাস্তব চিত্র। এগুলি থেকে চরিত্র গুলিকে বিচ্ছিন্ন করলে ব্যক্তির ব্যক্তি পরিচয় ও সামাজিক পরিচয় হিসেবে বর্ণহীন হয়ে পড়ে। তাই লেখক চরিত্র গুলির বিকাশে সমাজকে সর্বতোভাবে স্পর্শ করেছেন।

ব্যবধান গল্পে হিমাংশু ও বনমালী ভাই না হলেও অভিন্নহৃদয় এর উদাহরণ।

কতকগুলি গল্পে সামাজিক রীতিনীতির উর্ধ্বে নারী নিজ ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছে। যেমন নষ্টনীড়, স্ত্রীরপত্র, অপরিচিতা প্রভৃতি গল্প। এই সমাজে দাক্ষায়নীর মতো পতিব্রতা নারীও দুর্লভ নয়। দাক্ষায়ণী তার দুর্বল স্বামীকে সর্ববিষয়ে রক্ষা করবার জন্য যেমন ব্যস্ত, স্বামীর মান-সম্ভ্রম ও খ্যাতি প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য তেমনি সচেষ্ট। স্বামী দুর্ভাগ্যের জন্য সে নিজেকেই দায়ী মনে করে। স্বামীর সুখ-দুঃখে সমান অধিকারী দাক্ষায়ণী সেই সমাজের প্রতিনিধি। অনুরূপ ভাবে দৃষ্টিদান গল্পে কুমুদিনীও নিজের অন্ধতার জন্য সে স্বামীর উপর একান্তভাবেই নির্ভরশীল। এবং এ পেশায় নিজেকে সুখী মনে করে। যখন কুমুদিনীর স্বামী হেমাঙ্গিনীর প্রতি আসক্ত এমনকি বিবাহ করতে যাচ্ছে তখন স্বামীর প্রতি বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয় নি। বরং সত্য পথে ফিরিয়ে আনার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই। প্রতি হিংসা গল্পে অহংকার স্ফীত জমিদার পত্নীর অপমানের প্রতিশোধ সে এমন ভাবে নিয়েছে যাতে তার চরিত্রের মহিমার রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। চরম বিপদের দিনে ইন্দ্রানী নিজের গয়না বিক্রি করে প্রচুর সম্পত্তি রক্ষা করেছে। মুখরা চরিত্রেরও যে অভাব ছিলনা তার প্রমাণ ফটিকের মামি। ফটিক গ্রাম্য পরিবেশে পালিত সরল ছেলে। কিন্তু তার মামীর মমতাহীন রূঢ় ব্যবহার ফটিককে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে। রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা গুরু চরনের স্ত্রী বরদাসুন্দরী মুখরা চরিত্র। বড়দা সুন্দরীর কথাতেই তার চরিত্র ধরা পড়ে। আর 'স্বর্ণমৃগ'গল্পের মোক্ষদা সুন্দরী বৈদ্যনাথ কি গৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। অপূর্ব ও মৃন্ময়ী সমাজ জীবনের স্নিগ্ধ প্রেমের ছবি।

গ্রাম্য মামলা-মোকদ্দমা জালিয়াতি দলাদলি লোভ ঈর্ষা কুৎসা প্রবঞ্চনা দৈন্য পীড়িত এই সমাজ জীবনের মানবহৃদয়ের গভীর তলকেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষণে ক্ষণে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় নি। কন্যাদায়গ্রস্ত রামসুন্দর, শশীভূষণ, শিবরামের স্বরবৃত্ত ভ্রাতৃপ্রীতি, আপন অধিকার রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অছিমুদ্দি,নিজ স্বার্থ ত্যাগে সমুজ্জ্বল রাইচরণ,দাক্ষায়নীর পতিপ্রেম, রামকানাইয়ের সত্যনিষ্ঠা,-- পল্লীসমাজ এর পারিবারিক বন্ধন গুলিকে দৃঢ়তর করেছে। রামসুন্দরের অসহায়তা, রামকানাইয়ের নিঃসঙ্গ একাকীত্ব, বনমালী হিমাংশু মালীর আবাল্য বন্ধুত্বের ব্যবধান, ফকিরচাঁদ মাখনলালের গৃহত্যাগ,প্যারিসংকরের প্রতিহিংসা, কাদম্বিনীর মৃত্যুবরণ, মহামায়ার কুলত্যাগ,দুখিরামের স্ত্রী হত্যা, চন্দনার অভিমান-- সব‌ই এই সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের পরিনাম। এই সমাজকে বাদ দিয়ে রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা ব্যবধান তারাপ্রসন্নের কীর্তি দেনাপাওনা প্রতি হিংসা প্রায়শ্চিত্ত মধ্যবর্তিনী দান প্রতিদান সমস্যাপূরণ মহামায়া শাস্তি মুক্তির উপায় গুপ্তধন স্বর্ণমৃগ প্রভৃতি গল্পগুলি বর্ণহীন হয়ে যায়। আর ত্যাগ, জীবিত ও মৃত, পাত্র-পাত্রী ব্যবধান অপরিচিতা গল্পের কিছুই থাকে না। ফটিক সুভা তারাপদ মিনি শশী প্রভৃতি চরিত্র সেই সমাজের‌ই সৃষ্টি। সেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাদের জীবন বিপন্ন। সুতরাং এই চরিত্রগুলির আচার-ব্যবহার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ‌ই প্রতিফলিত হয়েছে। যা ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। চরিত্র গুলি সেই সমাজেরই অঙ্গীভূত হয়ে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজকে সর্বতোভাবে স্পর্শ করে গেছে।

No comments:

Post a Comment