Literary Tarashankar Banerjee's Rarh Jiban in Literature - Nabo Mukul

Latest

Bengali poem, Short story, essay and modern poems as education base

30 Aug 2020

Literary Tarashankar Banerjee's Rarh Jiban in Literature

সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে রাঢ় জীবন : প্রসঙ্গে পর্যালোচনা

Literary Tarashankar Bandyopadhyay

লেখিকা- খুশী সরকার

সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নিবিড়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে একদা কথাপ্রসঙ্গে জনৈক সাহিত্যিককে বলেছিলেন--" আমার বই বলুন আর যাই বলুন, সেটা হচ্ছে আমার এ 'রাঢ়ের'। এর ভেতর থেকেই আমার যা-কিছু সঞ্চয়। এখানকার মানুষ এখানকার জীবন নিয়ে লিখেছি, তার বেশী আমার আর কিছু নেই।"
আমার "সাহিত্য জীবন" গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,-- এদেশের মানুষকে জানার একটা অহংকার ছিল। এদের সঙ্গে মানুষ হিসেবে পরিচয়ের একটা বড় সুযোগ আমার হয়েছিল। তাই আমি এদের কথা লিখি। এদের কথা লিখবার অধিকার আমার আছে।"

তারাশঙ্করের সাহিত্যের বিন্যাস প্রসঙ্গে বলা যায় যে, এখানে মুসলমান উচ্চবর্ণের হিন্দু যথেষ্ট আছেন কিন্তু প্রায় স্থানেই হাড়ি, বাগদী, বাউরি, ডোম ও সাঁওতালের সংখ্যাধিক্য লক্ষণীয়।
তারপর জানাই সমাজের বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণী ও বৃত্তির জিবি মানুষের কথা আছে, যার মধ্যে জমিদার, নানা স্তরের চাষী,ছুতোর, কামার, মুচি, ডোম, নাপিত, বেদে, সাপুড়ে, পটুয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য আরো আছে বৈষ্ণব বাউল, শাক্ত তান্ত্রিক, সন্ন্যাসী ইত্যাদি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জীবন চিত্র। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে তিনি বহুতলা গোষ্ঠীর মানুষকে নিরালম্ব নাম-গোত্রহীন বিশ্বমানবের প্রতিভূ করে নয়, তাদের লীলাভূমিতে স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে স্বকীয় ও সঠিক পরিচয়ে এঁকেছেন।

বিভিন্ন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত করেছেন রাঢ়ের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক রূপটি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এবং সকল বর্ণনায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছু সমান নয় সেখানকার বিশেষ পরিচয়টি ফুটে উঠেছে। রাঢ়ের সামগ্রিক জীবন রূপের মধ্যে স্থান বিশেষে দেখা যাবে তার অনন্যতা।
আদিবাসী অধ্যুষিত রাঢ়ের তথা বীরভূমের জনজীবনের লঘুগুরু নানান বিষয় তারাশঙ্করের উপন্যাসে এসেছে।

কর্তা ঠাকুর -- রাঢ়ের অনেক পল্লীতে ধর্ম ঠাকুর ও শিবমূর্তির মিশ্রণে কিছু স্থানীয় দেবতার উদ্ভব হয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের কাহারদের এমন এক দেবতার বাবা ঠাকুর বা বেলবনের মহারাজ। এর পূজার বিবরণ বিবৃত হয়েছে উপন্যাসে কিন্তু মূর্তির প্রত্যক্ষ বর্ণনা নেই। লেখক বলেন তাহার দের বিশ্বাস এই কর্তা গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত রুদ্রাক্ষ ও উপমিত ধারী, মুণ্ডিত মস্তক ও পায়ে খড়ম, হাতে দন্ড, তিনি রাত্রে চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ান তার ইচ্ছাই কাহারদের মঙ্গল-অমঙ্গল হয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, পঞ্চানন শিব পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের অনেক স্থানে সর্ববিধ মঙ্গল বিধায়ক দেবতা রূপে পূজিত হন বাবা ঠাকুর নামে পূজিত হন।

কাল রুদ্র-- রাঢ়ের শৈব সম্প্রদায় ও তাদের নিজস্ব নানা পদ্ধতিতে শিব পূজার প্রাচীনতা বিষয়ে গবেষকরা সুনিশ্চিত ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস গুলিতে রাঢ়ের বিভিন্ন পল্লীতে পূজিত বহুতর শিবমূর্তির নাম পাই।
যেমন ময়ূরেশ্বর শিব, বাবা রক্তের সর বাবা জলেশ্বর। হাঁসুলী বাঁকের কাহারদের প্রধানতম দেবতা কাল রুদ্র।
কাহাররা তাকে কাল রুদ্দু এবং বুড়োশিব‌ও বলে।
তাদের ধারণা ইনি বেলতলায় বাবা ঠাকুর ও ধর্ম- রাজের চেয়ে বড়। কর্তা কাল রুদ্রের সহচর, কর্তার ইচ্ছায় তাদের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম, ভালো-মন্দ ঘটে। আর 'আদি বুড়া' কালরুদ্রের কৃপায় তাদের মরণ বাঁচন ও ভাগ্যফল লাভ হয়। একে তারা ভয় করে বেশি, এঁর বার্ষিক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজন উৎসব হয়।
কাহার---- তাহার দেশ সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে লিখেছেন,---" কাহার বলে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বাংলাদেশ নেই। হরিজন যাদের বলি আমরা, এদের মধ্যে যারা পালকি বইয়ে থাকে তারাই বাংলাদেশ কাহার। যেমন বাগদী সম্প্রদায়। বাগদিদের মধ্যে যারা পালকি বয় তারা বাগদী কাহার। যারা বয় না তারা শুধুই বাগদী।"

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন আমাদের গ্রামে বাউরীদের মধ্যে এবং ডোম মধ্যে কত কবি আছে। তাদেরই একজন কে নিয়ে আমার মানস সরোবরে স্নান করিয়ে আমার কবি উপন্যাসের নায়ক হিসাবে অভিষেক করেছি"।

তারাশঙ্কর তাঁর 'কবি' ও আরো কিছু রচনায় প্রেমকে
জীবনের এক অমূল্য সম্পদ রূপে দেখিয়েছেন। ঝুমুর দলের দেহোপজীবিনী বসন আত্মগ্লানি ও কুটিল ব্যাধিতে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।
নিতাইয়ের স্বার্থলেশহীন প্রেমের বিশল্যকরণী তার চেতনায় আশা, উদ্দীপনা ও জীবন তৃষ্ণা সঞ্চয় করেছে। প্রেম পরশমণির স্পর্শে অন্তরের এই সঞ্চয়ে দেহের অশুচিতা পরিবেশের গ্লানি কৃতকর্মের তুচ্ছ হয়ে জীবন আনন্দময় ও সার্থক হয়ে ওঠে। লেখক এর এই বোধ বসন ও নিতায়ের প্রেম চিত্রণে প্রকাশিত। বিশুদ্ধ প্রেমই নিতাই ও বসনের সকল দীনতা, কালিমা সর্বাংশে শুদ্ধ করে পাঠক হৃদয়ে তাদের মহান করে তুলেছে। রাইকমল, স্বর্গমর্ত, কবি প্রভৃতি রচনায় সমাপ্তিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ও লেখক এর বিশ্লেষণে যে বৈরাগ্য ময় প্রশান্ত পূর্ণতার সংবেদনা সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় তারাশঙ্কর নিজেও স্নিগ্ধ মধুর বৈষ্ণব জীবনাদর্শের আশ্রয়ে তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছেন।

উপন্যাসিক তারাশঙ্করের জীবনদর্শন সকল বক্তব্য কে ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর সুগভীর মানবতাবোধ। ভালো-মন্দের নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি দরদ তার রচনায় প্রতিফলিত। সমাজের ঘৃণিত অপাংক্তেয় ভ্রান্ত কর্মফলভোগী অনুতপ্ত দুঃখী নর নারীর প্রতি তার সহানুভূতি প্রবল।
'কবি' তে বোনের না হৃদয়ের অভিমান, অচরিতার্থতার বেদনা, পতিতাদের জীবন পিপাসা, রায় কমলে মরণাপন্ন পরী বা নাগিনী কন্যা সবলার দুঃখ শূন্যতাবোধ মর্মস্পর্শী হয়েছে লেখকের মমতার যোগে। 'কবি' তে নিতাইয়ের প্রতি আলিপুরের বৈষ্ণব মহান্তের সান্তনা বাক্যে তারাশঙ্করের উদার মানবপ্রেমের পরিচয় আছে, " জন্ম তো বড় কথা নয় বাবা, কর্মই বড় প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নাই বাবা।"

কাজী আবদুল ওদুদ লেখক সম্পর্কে বলেছেন----"তারাশঙ্করের হৃদয়টি বিশাল। কিন্তু তার দৃষ্টি সে তুলনায় কম পরিচ্ছন্ন।"
'কবি'র প্রথমাংশে আছে ঠাকুরঝির প্রভাবে নিতাইয়ের কবিত্ব ও প্রেমের স্ফুরণ। দ্বিতীয় অংশের লক্ষিত হয় ঝুমুর দল,বসন ও নিতাইয়ের পারস্পরিক আকর্ষণ বিকর্ষণ ও নিবিড় অনুরাগ, বসনের অকালমৃত্যু ও নিতাইয়ের জীবন বৈরাগ্য। ঠাকুরঝি সহ প্রথম দিকের অনেক চরিত্র মধ্যভাগে বিদায় নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নতুন পরিবেশে, ভিন্ন জীবনে স্থানান্তরিত হয়েছে কাহিনী। নিতাইয়ের জীবনের এই দুই পর্যায় প্লটে একপ্রকার ভাগরেখা সৃষ্টি করলে ও মূল কাব্যরস প্রবাহ ও নিতাই এর কবিতাময় প্রেমানুভূতি উপন্যাসের সার্থকতা পেয়েছে। একটি সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ চরিত্র ঘটনা সংস্থিতি গতিময়তা ও বিশিষ্ট ভাব মন্ডল সহযোগে কবি সুডৌল ফর্মের সমৃদ্ধ উপন্যাস।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা এর শেষ পর্বে উপকথা ও ইতিহাসের তুলনা তথা সম্পর্ক নির্ধারণ কালে অহেতুক জটিলতা উদ্ভব হয়েছে। লেখক এর অনুসরণে বলা যায় তেরোশো 50 ইংরেজি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দামোদর অজয় ময়ূরাক্ষী কোপাই এর বন্যায় হাঁসুলী বাঁকের উপকথার পটভূমি ভেসে গিয়েছে, পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আর বনোয়ারী মৃত্যু সংবাদ শেষে লেখকের মন্তব্য,-----" উপকথায় ছোট নদীটি ইতিহাসের বড় নদীতে মিশে গেল। ইতিহাসের নদীতে নৌকা ভাসিয়ে কাহারেরা এখন নতুন মানুষ। তাদের শ্রমিক জীবনে আবহমানকাল প্রচলিত প্রথা সংস্কার বিশ্বাস বর্জিত হয়েছে তবু চন্নন পুরের পাকা ঘুপচি কোয়াটার থেকে ও তাকাই বালি ভরা ওই হাসুলীবাঁকের দিকে। কিন্তু কি করে ফিরে যাবে তারা আগে পথ ধরবে কে? তারপর জানা যায় হাঁসুলী বাঁকের করালি ফিরছে, শাবল হাতে গাড়ি চালাচ্ছে বালি কাটছে আর মাটি খুঁজছে। উপকথায় কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে। নতুন হাসুলি বাঁক।
উপন্যাসটির শেষের 4 পৃষ্ঠা পাঠে লক্ষ্য করা যায় জনশ্রুতি ঘটনা দেশব্যাপী জীবনধারা ও রীতি লক্ষণকে ইতিহাস বলা হয়েছে। তাই১৯৪৩ এর পশ্চিমবঙ্গের বন্যা ও ইতিহাস যুদ্ধ শিল্পায়ন নগরমুখীনতাও ইতিহাস। করালি হাসুলীবাঁকের কাহারদেরকে কুপমন্ডুকতা ঘুচিয়ে বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটালো। কৃষি ছেড়ে শ্রমিকেরা জীবিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিশেষত হাঁসুলী বাঁকের উপকথার ছোট নদী ও ইতিহাসের বড় নদীর প্রভেদ কল্পনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, কিন্তু আমাদের আপত্তি হাসুলীবাঁকের করালি ফিরে আসার ঘটনায়। যে করালি টিকে থাকা কাহার সংস্কৃতিকে আঘাত হানল সেই আবার নতুন কাহারপাড়া গড়তে নতুন হাঁসুলি বাঁক খুঁজতে চাইবে কেন ? সে আধুনিক কাহার কলোনির যদি গড়তে চাই তার স্থান কি অবধারিতভাবে সেই হাসুলীবাঁক যা বিপদগ্রস্থ। শ্রমিক জীবনে তারেই প্রকার জাতিগত গোষ্ঠী চেতনা জাগল কিভাবে ? চৈতালি ঘূর্ণি তার জীবিকা কত শ্রেণি চেতনার জাগরণ স্বাভাবিক এবং লেখক এর ইতিহাস যুক্ত হতো আঞ্চলিকতাকে জয়ী করতে---- লেখক করা লিকে হাসুলীবাঁকের কাহারপাড়া পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব দিয়ে শিল্পগত সামঞ্জস্য পূর্ণ করেছেন।
Literary review in Rarh Life of Tarasankar Bandyopadhyay
কপিরাইত@খুশি সরকার - রচনাকালঃ- ৩১.০৮.২০২০।

No comments:

Post a Comment