Upendrakishore Roy Chowdhury in Children's Literature: Extraordinary talent, personality and vastness of action.
১৬০০ খিষ্টাব্দের আগে নদীয়ার চাকদহ থেকে দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ রামসুন্দর বিহার থেকে বাংলায় এলেন। বিহারে তাঁর পদবী ছিল 'দেও' সেই পদবী বাংলায় হল 'দেব'। রামসুন্দরের নাতির ছেলে রামনারায়ন মসুয়ায় ঘরবাড়ি তৈরি করে জ্ঞান বিদ্যা ও ভাষা চর্চায় খুব সুনাম করেছিলেন। এই সময় তাদের পদবী দেব থেকে রায় হয় এবং পরে তাদেরই এক শরিক জমিদারি করে রায়চৌধুরী নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই রামনারায়ণের নাতির ছেলে রামকান্ত। রামকান্তের দুই ছেলে লোকনাথ এবং ভোলানাথ।
লোকনাথ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন যেমন তার অংকে মাথা ছিল তুখোড় তেমনি জরিপেও। আরবি-ফারসি এবং সংস্কৃত তাঁর ভাষাজ্ঞান ছিল দক্ষতা পূর্ণ। তিনি অনায়াসেই যেকোনো একটি ভাষার বই খুলে অনর্গল মুখে অন্য দুই ভাষায় তরজমা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন জীবনের শক্তি সাধনার পথ। নির্জন শ্মশানে নরকপাল, মানুষের অস্থিখন্ড দিয়ে তৈরি মহাশঙ্খের মালা আর ডামর গ্রন্থ নিয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। রামকান্ত ছেলেকে সংসারী করবার জন্য কৃষ্ণমণি নামে এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে লোকনাথের বিয়ে দিলেন কিন্তু ছেলের মতি না ফেরাই তিনি একদিন ডামর গ্রন্থ নরকপাল এবং মহাশঙ্খের মালা ভাসিয়ে দিলেন ব্রহ্মপুত্রের জলে। ফল হলো বিপরীত লোকনাথ তিন দিন অসুস্থ থেকে হতাশায় প্রাণ ত্যাগ করলেন, তখন স্ত্রী কৃষ্ণমণি ছিলেন গর্ভবতী। অবশ্য মৃত্যুর আগে লোকনাথ স্ত্রীকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, "দুঃখ করো না তোমার এই এক ছেলে থেকে ১০০ হবে।" এই লোকনাথ রায়ের ছেলে কালিনাথ রায় কিন্তু লোকে তাকে ডাকতো শ্যামসুন্দর বলে। শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সি এই কামদারঞ্জনকেই অপুত্রক জমিদার হরিকিশোর দত্তক নেন এবং এই সময় শর্ত দেওয়া ছিল যে পরবর্তীকালে হরিকিশোরের ছেলে হলেও কামদারঞ্জনই পুরো সম্পত্তি পাবে। অবশ্য পরবর্তীকালে হরিকিশোরের এক ছেলে হয়, নাম নরেন্দ্রকিশোর।
দত্তকপুত্র উপেন্দ্রকিশোর:-
শ্যামসুন্দর ওরফে কালিনাথের দ্বিতীয় সন্তান কামদারঞ্জনের জন্ম হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২শে মে (১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ)। কামদারঞ্জনের চরিত্রে ঠাকুরদাদা লোকনাথ রায়ের ক্ষমতা এবং মেধা প্রকাশ পেয়েছিল।
উপেন্দ্রকিশোরের বাল্যকালের মানসিকতা:-
উপেন্দ্রকিশোরকে হরিকিশোর কোনো কারণে একটু কেউ শাসন করলেই শ্যামসুন্দর এবং হরিকিশোরের বাড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এমন পরিত্রাহি কান্না জুড়ে দিতেন যে তার মা জয়তারা তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। একদা হরিকিশোরের ভাইজি লীলা মজুমদার লিখেছিলেন যে, "ছেলে তো নয়, হরিকিশোর সিংহের বাচ্চা ঘরে এনেছিলেন। তারা কখনো পোষ মানে না সর্বদা নিজের বুদ্ধিতে চলে। তাদের এমন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব থাকে যে, প্রভাবিত করতে হলে যেমন তেমন লোক দিয়ে চলে না"।
সত্যি হরিকিশোর এমন একজনকে দত্তক নিয়েছিলেন যার জমির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না, শুধু তাই নয় ভাই নরেন্দ্রের উপর জমিদারি ছেড়ে দিয়ে নিজে বিদ্যাচর্চায় মন দিয়েছিলেন। শ্যামসুন্দর ছিলেন প্রগতিশীল আর হরিকিশোর ছিলেন প্রাচীনপন্থী। ফলে উপেন্দ্রকিশোর বাবার মতোই তার মন ছিল প্রগতিশীল। তাঁর লেখাপড়া থেকে গান-বাজনায় শখ ছিল বেশী। ফলে তার সঙ্গী ছিল বাঁশী এবং পরে বেহালা। অবশ্য পড়াশোনা করতে দেখা না গেলেও স্কুলের মাস্টারমশাই পড়া ধরলে ঠিক ঠিক বলে দিতেন। আসলে তার অনর্গল মুখস্ত বিদ্যা ছিল অন্য ছেলেদের পড়া শুনে শুনেই পড়ার তৈরি হয়ে যেত। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময় বইপত্র নিয়ে বসতেন।
নতুন আলোকে উপেন্দ্রকিশোর:-
স্কুলের বন্ধু গগনচন্দ্র হোম এর সঙ্গে তার সখ্যতা বাড়ে। গগনচন্দ্র ছিলেন রামমোহন রায়ের 'ব্রাহ্মসমাজ' এর প্রতি আগ্রহী। আর জাতপাতহীন মানসিকতা, ঠাকুর দেবতা বিশ্বাস, মেয়েদের শিক্ষা - সমস্ত কিছুই যুক্তিপূর্ণ ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ এবং পুরনো নিয়ম কানুনের প্রতি অনাস্থা থেকে নতুনের প্রগতিশীল মানসিকতা উপেন্দ্রকিশোরের ভালো লাগতো। তাই হরিকিশোর গগন চন্দ্রের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরকে মেলামেশা করতে নিষেধ করেন কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তার চোখ এড়িয়ে জঙ্গলে গিয়ে ধর্ম সমাজ সংস্কার, নিরাকার ব্রহ্ম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন। ছোটবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অংক ও বিজ্ঞান যেমন খুব ভালোবাসতেন তেমনি ছবি আঁকার হাত ছিল অপূর্ব। একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শন করতে আসা বাংলা ছোট লাট সাহেবের ছবি ক্লাসেই সাক্ষাৎ দেখে দেখে এঁকে ফেলেছিলেন। তা দেখে সাহেব খুশি হয়ে পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন," এ জিনিসের চর্চা তুমি কখনো ছেড়ো না, বড় হয়ে এ লাইনেই যেও।"
১৮৭৯ সালে উপেন্দ্রকিশোর ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৫ টাকা বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর মসূয়া ছেড়ে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৮৮৪ সালে তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট থেকে বি.এ পাশ করেন। রাজা রামমোহন রায়ের সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে আধুনিক মনস্কতায় সভ্য হন। এখানকার সভ্য ছিলেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এবং তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
বিবাহ:-
জোড়াসাঁকোর গান বাজনার চর্চার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের আলাপ হয়। কলকাতায় এসে তিনি হাতে তুলে নেন ক্যামেরা, শুরু হয় তার আলোছায়ার রহস্য নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ছোটখাটো যন্ত্রপাতি নিয়ে বিজ্ঞানচর্চা। কলকাতায় থাকাকালীন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার পরিবারের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা তার আত্মীয় পরিজন এরমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে ততদিনে শ্যামসুন্দর এবং বৃদ্ধ হরিকিশোর মারা গেছেন। মা জয়তারা কষ্ট পেলেও প্রকাশ করেন নি। এখান থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের জীবনধারা আলাদা হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রে তারা থাকুর দাদা লোকনাথের সঙ্গে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। মাত্র ২১ পেরোনোর আগেই ছবি তোলা ছবি আঁকা এবং ছাপার কাজে উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছে চার দিকে। উপার্জনও হচ্ছে কিছু। হরিকিশোরের মৃত্যুর পর সম্পত্তি উপেন্দ্রকিশোর এবং নরেন্দ্রকিশোরের মধ্যে ভাগ হলেও তিনি জমিদারি নিয়ে কখনো মাথা ঘামান নি বরং নরেন্দ্রকিশোর জমিদারের আয় থেকে তাকে যা দিয়েছেন তাই খুশি হয়ে নিতেন। নিজের আগ্রহে মাত্র ২৩ বছর বয়সে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বড় মেয়েকে বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। একে ব্রাহ্ম হওয়া এবং অন্যদিকে ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করা-- এই দুই বিষয়ে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে এমন কি মা জয়তারও এরপর আর কখনো তার বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন নি। বিধুমুখী সুন্দরী না হলেও ছিলেন শান্ত সবের এবং স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব পরায়ন এই মিষ্টি সহজেই মুগ্ধ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ব্রাহ্ম মতে ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাইয়েরা কলকাতায় উঠে এলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়।
নিজস্বতায় একাকী :--
কলকাতার কর্নওয়ালিস স্টুডেন্টরা নম্বর বাড়িতেই উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখী সুখলতা, পুণ্যলতা, শান্তিলতা ও দুই ছেলে সুকুমার সুবিনয়কে নিয়ে বসবাস করতেন। পরে শিবনারায়ন দাস লেনের বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর জ্ঞান বিদ্যার সাধনা করেন কিন্তু কখনো সংসার এড়িয়ে নির্জনতার খোঁজ করেন নি। সংসারের সব ছেলে মেয়ের দায়িত্ব পালন করেও তিনি নিজের ছাপা, ছবি ও পাঠ্য বিষয় নিয়ে মগ্ন থাকতেন ছেলে মেয়ের প্রতি স্নেহশীল পিতার মতোই তাদের নিয়ে বনভোজন জাদুঘর চিড়িয়াখানা এমনকি দার্জিলিং,পুরী,গিরিডি- ঘুরতে যেতেন। আর একদিকে ছিল সংসার বন্ধুবান্ধব অন্যদিকে জীবনের গান জ্ঞানসাধনার ব্রত কোনোটাতেই তিনি অবহেলা করেননি তার শিল্পচর্চা সাহিত্য রচনা ছোটদের পত্রিকা এইসব ক্ষেত্রে তিনি লাভের কথা না ভেবে কেবলমাত্র আনন্দ দানের জন্য এগুলো করতেন এইবার এরই একটি অন্ধকার ঘরে তার ছবি তোলা কাজ হতো অন্য ঘরে থাকতো ইজেলে টাঙানো ক্যানভাস। যখন যে কাজটা করতেন তখনই বিশ্বজগত ভুলে নিবিষ্ট মনে করতেন। প্রতিভার সঙ্গে ছিল আপ্রাণ চেষ্টা। তার আলস্য ছিল না, ছিল না বিশ্রাম। শুধু ছিল বহু শ্রমে এত করা বিদ্যা কেউ শিখতে চাইলে সেই বিদ্যা দানে তাঁর উৎফুল্লতা।
মুদ্রণশিল্পে অবদান:--
হাতে-কলমে কাজ করতে করতে তিনি আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন এবং নিজের খরচের থেকে যন্ত্রপাতি এনে নিজস্ব ছাপাখানা 'ইউ রায় এন্ড সন্স' স্থাপন করেন এবং শুরু করেন ভারতে প্রথম হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং এর কাজ। এছাড়া এই বাড়িতেই একটি ঘরে ছবি তোলার এবং ছবি আঁকার ষ্টুডিও হলো একটি ঘরে প্রেস অন্য ঘরের বারান্দার মিলে সাজানো হলো দরকারই যন্ত্রপাতি। একটি ছোট স্নানঘর হলো ডার্করুম। সেখানেই তিনি নিবিষ্টমনে হাফটোন ব্লক কে ছাপার কাজ কেমন করে আরো উন্নত করা যায় তার চর্চা করতে লাগলেন চালালেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিখলেন বিলিতি মুদ্রণ পদ্ধতি। ফটো টেকনিক সংক্রান্ত পত্রিকা 'পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল' এ প্রবন্ধ পাঠাতে লাগলেন একের পর এক। এইরকম নটি প্রবন্ধ ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত সাহেবরা তার প্রগাঢ় জ্ঞানে বিস্মিত হয়ে ছাপেন। তাঁর এই উদ্ভাবনী শক্তির ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতেও আছে। বহু বিদেশ থেকে ছাপাখানার কাজ দেখার জন্য অনেকে আসতেন তাঁর ভাড়াবাড়িতে। নিজস্ব পুঁজি, কিছু যন্ত্রপাতি এবং অসামান্য প্রতিভা- মাত্র এই তিনটি মূলধন নিয়েই তিনি করেছিলেন অসাধ্য সাধন। সে সময় ছবি ছাপা হতো কাঠের উপরে খোদাই করা উডকাট কিংবা ইস্পাতের পাতের সাহায্যে। উপেন্দ্রকিশোর বুঝেছিলেন তামা বা দস্তার পাতে খোদাই করে ছবি ছাপলে আরো পরিষ্কার এবং স্পষ্ট হবে। হাফটোন এবং লাইন ব্লক নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে তিনি যেসব উন্নত প্রণালী চালু করেছিলেন তাতে সারা পৃথিবীর মুদ্রণশিল্প উপকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ছাপাখানা আরো বড় হয়। ১৯০০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন ২২নং সুকিয়া স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে। সেখানে আত্মীয় স্বজনের আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। এমনকি চিকিৎসার প্রয়োজনে আসা এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা অনেকদিন তাঁর বাড়িতে ছিলেন। সবাইকে সেই মহিলা অতিষ্ঠ করে তুলেছিল কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের প্রসন্ন গম্ভীর ব্যক্তিত্বে তার কোনো আঁচ লাগে নি।
উপেন্দ্রকিশোর - সংগীত, মহাকাব্য এবং শিশুসাহিত্যে :-
উপেন্দ্রকিশোর শিখেছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীত। চর্চাও করতেন এবং শেখাতেনও। বেহালা ছাড়া বাজাতেন পাখোয়াজ, সেতার, হারমোনিয়াম, বাঁশি।
আর মেজো মেয়ে পূণ্যলতা "বাবার কথা" নিবন্ধে লিখেছেন, "বেহালা তাঁর যেমন প্রিয় ছিল, বেহালার হাতও ছিল তাঁর তেমনি অসাধারণ...."। তিনি যখন তন্ময় হয়ে বেহালা বাজাতেন তখন লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনতো। একবার আর মেয়ের অসুস্থতায় যখন ওষুধেও ঘুম আসত না তখন তিনি বেহালা বাজিয়ে ঘুম পাড়াতেন। পুণ্যলতা কথাই উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন কথাবার্তার মানুষ ছোট-বড় সকলের সঙ্গেই বৃষ্টি ও ভদ্র ব্যবহার করতেন শুধু তাই নয় কেউ কাউকে অভদ্রতা দেখালে তিনি তিনি চমৎকারভাবে তাকে ভদ্রতা শিখিয়ে দিতেন। একদিন পোস্ট অফিসে উপেন্দ্রকিশোর খুব ভদ্রভাবে পোস্টমাস্টার কে তার কাজ করে দিতে অনুরোধ করেন কিন্তু লোকটি খিঁচিয়ে উঠে বলে, "দেখছেন তো মশাই কাজ করছি, আমার কি চারটে হাত ?" উপেন্দ্রকিশোর শান্ত স্বরে বললেন, "কি জানি মশাই, বয়স তো হয়েছে, অনেক দেশে ঘুরেছিও, কিন্তু চারটে হাতওয়ালা পোস্টমাস্টার তো কখনো কোথাও দেখি নি, তবে দুটো হাত দিয়েই তারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজ করেন"। পোস্টমাস্টার লজ্জিত হয়ে কাজটি দ্রুত করে দেন।
বহু ধর্মসংগীত তিনি রচনা করেছেন। তার মতে পরম ব্রহ্মের কাছে নিজেকে সঁপে দিলে আর কোন ভয় থাকেনা। হাজারো কাজের ব্যস্ততার মাঝেও স্পর্শকের মত ছুঁয়ে থাকো তা হৃদয়। এখনো তার ব্রহ্মসঙ্গীত নিয়মিত ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের উপাসনায় গাওয়া হয়।
উপেন্দ্রকিশোর মনে করতেন রামায়ণ মহাভারত এই দুই মহাকাব্যে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারাগুলো মিশে আছে। এইগুলো কাছে রাখতে পারলে একা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। এজন্য তিনি ছোটদের জন্য রামায়ণ মহাভারত লিখলেন নতুন করে। আসল কাহিনী একই রইল কিন্তু গল্প বলার সৌন্দর্য চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে উঠলো। ছোটদের মত আদুরে হলেন না, বুড়োদের মত গম্ভীর হলেন না, নীতি কথার উপরে জোর দিলেন না--- খুব সুন্দর সাদা কালো রঙিন ছবি দিয়ে একেবারে ছোটদের মনের মত করে তুললেন দুই মহাকাব্যকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়বে এবং আনন্দ করে শিখবে। শিশুসাহিত্যের কোথাও মাস্টারমশাই গিরি থাকবে না--- এই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের নীতি। ভালো কাজ কাগজ ভালো রং ছাপার কালি ব্যবহার করে ভালোবেসে নিষ্ঠার সঙ্গে ছবি আঁকতেন কিন্তু ছাপা মনের মত না হলেই ফেলে দিতেন। হাফটোন ব্লক তৈরিতে কাজে গবেষণা তা তিনি পেনরোজ কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার আবিষ্কার কে কাজে লাগিয়ে কিংবা তার কাছেই কাজ শিখে কারা কারা তার সংস্থা ইউ রায় এন্ড সন্স এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল কিংবা লাখপতি হয়ে গেল তা নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না। এমনকি তিনি জমিদারি থেকে প্রাপ্য অর্থে কোনোদিন বিলাস করেননি বরং যা ব্যয় করেছেন নিজস্ব গবেষণার উন্নতির জন্য, প্রয়োজনে জমি বন্ধক রেখেছেন কিন্তু টাকা না হলে কি হবে তার চিন্তা কখনো স্পর্শ করেনি তাঁকে। শুধু ছোটদের রামায়ণ মহাভারত লেখেননি তিনি লিখেছেন আকাশের কথা বা টুনটুনির বই, এবং নানা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সংগীত ও চিত্রকলার সম্পর্ক গান বাজনার সাত সুর আর ছবি আঁকার সাত রঙের সাযুজ্য নিয়েও তার প্রবন্ধ আছে। ফটোগ্রাফি এবং প্রিন্টিং নিয়ে জটিল বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন বেচারাম ও কেনারাম গুপী গাইন ও বাঘা বাইন।
উপেন্দ্রকিশোরের চিন্তার পরিধি ছিল বহুবিস্তৃত ১৯১৩ সালে ৫০ বছর বয়সে তার দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্নপূরণের কাজে হাত দেন সেটি হল ছোটদের জন্য এক ভালো মাসিক পত্রিকা প্রকাশ। পত্রিকাটির নাম সন্দেশ ।প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে। বাংলায় ছোটদের লেখালেখির জগতে এইভাবে তিনি আনলেন এক নতুন যুগ। প্রথম সংখ্যাটি তে যেমন ছিল পাঠ্যপুস্তক বৈচিত্র্য তেমনি ছিল চকচকে ছাপা উজ্জ্বল ছবি আর আকর্ষণীয় মলাট। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য লিখতে সন্দেশ কে বেছে নিলেন দেশের বহু গুণী মানুষ যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদীশচন্দ্র বসু কুমুদ রঞ্জন মল্লিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো অনেকে। তারা বিনা পাস নাকি স্বেচ্ছায় লেখা দিতেন এবং সম্পাদক আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে নিজের পকেট থেকে, এসব তারা করতেন শুধু ছোটদের মুখ চেয়ে।
দায়ভার অর্পণ:-
১৯১৪ সালে আবার বাড়ি বদল করে এলেন ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে। তখন পুত্র সুকুমার বিলেত থেকে ফিরে এসে সন্দেশে যুক্ত হলেন আর আশ্চর্য সরস গল্প কবিতা আর তুলি দিয়ে আঁকা সাদা কালো ছবি নিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর বুঝতে পারলেন তাঁর উত্তরসূরি উপস্থিত। শরীরে বুঝতে পারছেনা ক্লান্তির অস্তিত্ব এবং ৫২ বছর বয়সে ধরা পরল ডায়াবেটিস। এরপর সন্দেশ ছেড়ে দিলেন দুই পুত্র সুকুমার ও সুবিনয়ের হাতে। তখন ডায়াবেটিসের কোন ওষুধ ছিল না, তাই বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্যের সন্ধানে ঘুরেও কোনো উন্নতি হলো না। অবশেষে ৫৩ বছরে মৃত্যুর জন্য নিজেকে তৈরি করলেন। দুশ্চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই, সেই শান্ত প্রসন্ন মুখ। কাজ করছেন, চিঠিপত্র লিখছেন, সকলের সঙ্গে দেখা করছেন আবার রোগশয্যাতেই রোজ বেহালা বাজাচ্ছেন। ব্রহ্ম চিন্তায় তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল। তিনি হাসিমুখে অমৃত লোকে যাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করতে শুরু করলেন।
শেষ যাত্রা:-
১৯১৫ সালের ২০ই ডিসেম্বর এল সেই অপেক্ষার দিন। লীলা মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "ভোর বেলায় তাঁর জানালায় এসে গান গেয়ে গেল একটি পাখি। বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়েছিলেন শোকগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজন। তাদের দিকে ফিরে স্মিত মুখে উপেন্দ্রকিশোর বলেছিলেন," পাখি কি বলে গেল জানো? সে বললে, যাও, চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।" ক্লান্তি জড়ানো গলায় বিধুমুখীকে বলেছিলেন চোখ বুঝলেই কি সুন্দর আলো দেখি। ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি পুরনো দিনের বিগত বন্ধুবান্ধব প্রিয়জনেরা কাছে এসে বসেছেন। এর মধ্যে দুঃখের স্থান কোথায়?-
ধীরে ধীরে ৫৩ বছরের পুরনো রোগক্লান্ত দেহটি পড়ে রইল- তিনি পাড়ি দিলেন চিরশান্তির জগতে। আজও শিশু-কিশোরদের জন্য যে পত্রপত্রিকার তৈরি হয় লেখালেখি ছবি আঁকা হয়, সবকিছুই নতুন রূপ পেয়েছিল পারি হাত ধরে। আজও টুনটুনির গল্প শুনে শুনে একটু বড় হওয়া শিশুরা যখন 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' এর স্বপ্ন দেখে আকাশের কথা পড়ে আবার বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকায়, সেই বিস্ময় মাখা দৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকেন চির-কিশোর সেই স্রষ্টা।
শিশুসাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী : অসাধারন প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মের বিশালতা।
উপেন্দ্রকিশোরের পরিচিতি:১৬০০ খিষ্টাব্দের আগে নদীয়ার চাকদহ থেকে দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ রামসুন্দর বিহার থেকে বাংলায় এলেন। বিহারে তাঁর পদবী ছিল 'দেও' সেই পদবী বাংলায় হল 'দেব'। রামসুন্দরের নাতির ছেলে রামনারায়ন মসুয়ায় ঘরবাড়ি তৈরি করে জ্ঞান বিদ্যা ও ভাষা চর্চায় খুব সুনাম করেছিলেন। এই সময় তাদের পদবী দেব থেকে রায় হয় এবং পরে তাদেরই এক শরিক জমিদারি করে রায়চৌধুরী নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই রামনারায়ণের নাতির ছেলে রামকান্ত। রামকান্তের দুই ছেলে লোকনাথ এবং ভোলানাথ।
লোকনাথ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন যেমন তার অংকে মাথা ছিল তুখোড় তেমনি জরিপেও। আরবি-ফারসি এবং সংস্কৃত তাঁর ভাষাজ্ঞান ছিল দক্ষতা পূর্ণ। তিনি অনায়াসেই যেকোনো একটি ভাষার বই খুলে অনর্গল মুখে অন্য দুই ভাষায় তরজমা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন জীবনের শক্তি সাধনার পথ। নির্জন শ্মশানে নরকপাল, মানুষের অস্থিখন্ড দিয়ে তৈরি মহাশঙ্খের মালা আর ডামর গ্রন্থ নিয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। রামকান্ত ছেলেকে সংসারী করবার জন্য কৃষ্ণমণি নামে এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে লোকনাথের বিয়ে দিলেন কিন্তু ছেলের মতি না ফেরাই তিনি একদিন ডামর গ্রন্থ নরকপাল এবং মহাশঙ্খের মালা ভাসিয়ে দিলেন ব্রহ্মপুত্রের জলে। ফল হলো বিপরীত লোকনাথ তিন দিন অসুস্থ থেকে হতাশায় প্রাণ ত্যাগ করলেন, তখন স্ত্রী কৃষ্ণমণি ছিলেন গর্ভবতী। অবশ্য মৃত্যুর আগে লোকনাথ স্ত্রীকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, "দুঃখ করো না তোমার এই এক ছেলে থেকে ১০০ হবে।" এই লোকনাথ রায়ের ছেলে কালিনাথ রায় কিন্তু লোকে তাকে ডাকতো শ্যামসুন্দর বলে। শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সি এই কামদারঞ্জনকেই অপুত্রক জমিদার হরিকিশোর দত্তক নেন এবং এই সময় শর্ত দেওয়া ছিল যে পরবর্তীকালে হরিকিশোরের ছেলে হলেও কামদারঞ্জনই পুরো সম্পত্তি পাবে। অবশ্য পরবর্তীকালে হরিকিশোরের এক ছেলে হয়, নাম নরেন্দ্রকিশোর।
দত্তকপুত্র উপেন্দ্রকিশোর:-
শ্যামসুন্দর ওরফে কালিনাথের দ্বিতীয় সন্তান কামদারঞ্জনের জন্ম হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২শে মে (১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ)। কামদারঞ্জনের চরিত্রে ঠাকুরদাদা লোকনাথ রায়ের ক্ষমতা এবং মেধা প্রকাশ পেয়েছিল।
উপেন্দ্রকিশোরের বাল্যকালের মানসিকতা:-
উপেন্দ্রকিশোরকে হরিকিশোর কোনো কারণে একটু কেউ শাসন করলেই শ্যামসুন্দর এবং হরিকিশোরের বাড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এমন পরিত্রাহি কান্না জুড়ে দিতেন যে তার মা জয়তারা তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। একদা হরিকিশোরের ভাইজি লীলা মজুমদার লিখেছিলেন যে, "ছেলে তো নয়, হরিকিশোর সিংহের বাচ্চা ঘরে এনেছিলেন। তারা কখনো পোষ মানে না সর্বদা নিজের বুদ্ধিতে চলে। তাদের এমন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব থাকে যে, প্রভাবিত করতে হলে যেমন তেমন লোক দিয়ে চলে না"।
সত্যি হরিকিশোর এমন একজনকে দত্তক নিয়েছিলেন যার জমির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না, শুধু তাই নয় ভাই নরেন্দ্রের উপর জমিদারি ছেড়ে দিয়ে নিজে বিদ্যাচর্চায় মন দিয়েছিলেন। শ্যামসুন্দর ছিলেন প্রগতিশীল আর হরিকিশোর ছিলেন প্রাচীনপন্থী। ফলে উপেন্দ্রকিশোর বাবার মতোই তার মন ছিল প্রগতিশীল। তাঁর লেখাপড়া থেকে গান-বাজনায় শখ ছিল বেশী। ফলে তার সঙ্গী ছিল বাঁশী এবং পরে বেহালা। অবশ্য পড়াশোনা করতে দেখা না গেলেও স্কুলের মাস্টারমশাই পড়া ধরলে ঠিক ঠিক বলে দিতেন। আসলে তার অনর্গল মুখস্ত বিদ্যা ছিল অন্য ছেলেদের পড়া শুনে শুনেই পড়ার তৈরি হয়ে যেত। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময় বইপত্র নিয়ে বসতেন।
নতুন আলোকে উপেন্দ্রকিশোর:-
স্কুলের বন্ধু গগনচন্দ্র হোম এর সঙ্গে তার সখ্যতা বাড়ে। গগনচন্দ্র ছিলেন রামমোহন রায়ের 'ব্রাহ্মসমাজ' এর প্রতি আগ্রহী। আর জাতপাতহীন মানসিকতা, ঠাকুর দেবতা বিশ্বাস, মেয়েদের শিক্ষা - সমস্ত কিছুই যুক্তিপূর্ণ ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ এবং পুরনো নিয়ম কানুনের প্রতি অনাস্থা থেকে নতুনের প্রগতিশীল মানসিকতা উপেন্দ্রকিশোরের ভালো লাগতো। তাই হরিকিশোর গগন চন্দ্রের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরকে মেলামেশা করতে নিষেধ করেন কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তার চোখ এড়িয়ে জঙ্গলে গিয়ে ধর্ম সমাজ সংস্কার, নিরাকার ব্রহ্ম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন। ছোটবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অংক ও বিজ্ঞান যেমন খুব ভালোবাসতেন তেমনি ছবি আঁকার হাত ছিল অপূর্ব। একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শন করতে আসা বাংলা ছোট লাট সাহেবের ছবি ক্লাসেই সাক্ষাৎ দেখে দেখে এঁকে ফেলেছিলেন। তা দেখে সাহেব খুশি হয়ে পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন," এ জিনিসের চর্চা তুমি কখনো ছেড়ো না, বড় হয়ে এ লাইনেই যেও।"
১৮৭৯ সালে উপেন্দ্রকিশোর ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৫ টাকা বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর মসূয়া ছেড়ে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৮৮৪ সালে তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট থেকে বি.এ পাশ করেন। রাজা রামমোহন রায়ের সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে আধুনিক মনস্কতায় সভ্য হন। এখানকার সভ্য ছিলেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এবং তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
বিবাহ:-
জোড়াসাঁকোর গান বাজনার চর্চার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের আলাপ হয়। কলকাতায় এসে তিনি হাতে তুলে নেন ক্যামেরা, শুরু হয় তার আলোছায়ার রহস্য নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ছোটখাটো যন্ত্রপাতি নিয়ে বিজ্ঞানচর্চা। কলকাতায় থাকাকালীন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার পরিবারের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা তার আত্মীয় পরিজন এরমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে ততদিনে শ্যামসুন্দর এবং বৃদ্ধ হরিকিশোর মারা গেছেন। মা জয়তারা কষ্ট পেলেও প্রকাশ করেন নি। এখান থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের জীবনধারা আলাদা হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রে তারা থাকুর দাদা লোকনাথের সঙ্গে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। মাত্র ২১ পেরোনোর আগেই ছবি তোলা ছবি আঁকা এবং ছাপার কাজে উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছে চার দিকে। উপার্জনও হচ্ছে কিছু। হরিকিশোরের মৃত্যুর পর সম্পত্তি উপেন্দ্রকিশোর এবং নরেন্দ্রকিশোরের মধ্যে ভাগ হলেও তিনি জমিদারি নিয়ে কখনো মাথা ঘামান নি বরং নরেন্দ্রকিশোর জমিদারের আয় থেকে তাকে যা দিয়েছেন তাই খুশি হয়ে নিতেন। নিজের আগ্রহে মাত্র ২৩ বছর বয়সে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বড় মেয়েকে বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। একে ব্রাহ্ম হওয়া এবং অন্যদিকে ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করা-- এই দুই বিষয়ে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে এমন কি মা জয়তারও এরপর আর কখনো তার বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন নি। বিধুমুখী সুন্দরী না হলেও ছিলেন শান্ত সবের এবং স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব পরায়ন এই মিষ্টি সহজেই মুগ্ধ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ব্রাহ্ম মতে ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাইয়েরা কলকাতায় উঠে এলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়।
নিজস্বতায় একাকী :--
কলকাতার কর্নওয়ালিস স্টুডেন্টরা নম্বর বাড়িতেই উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখী সুখলতা, পুণ্যলতা, শান্তিলতা ও দুই ছেলে সুকুমার সুবিনয়কে নিয়ে বসবাস করতেন। পরে শিবনারায়ন দাস লেনের বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর জ্ঞান বিদ্যার সাধনা করেন কিন্তু কখনো সংসার এড়িয়ে নির্জনতার খোঁজ করেন নি। সংসারের সব ছেলে মেয়ের দায়িত্ব পালন করেও তিনি নিজের ছাপা, ছবি ও পাঠ্য বিষয় নিয়ে মগ্ন থাকতেন ছেলে মেয়ের প্রতি স্নেহশীল পিতার মতোই তাদের নিয়ে বনভোজন জাদুঘর চিড়িয়াখানা এমনকি দার্জিলিং,পুরী,গিরিডি- ঘুরতে যেতেন। আর একদিকে ছিল সংসার বন্ধুবান্ধব অন্যদিকে জীবনের গান জ্ঞানসাধনার ব্রত কোনোটাতেই তিনি অবহেলা করেননি তার শিল্পচর্চা সাহিত্য রচনা ছোটদের পত্রিকা এইসব ক্ষেত্রে তিনি লাভের কথা না ভেবে কেবলমাত্র আনন্দ দানের জন্য এগুলো করতেন এইবার এরই একটি অন্ধকার ঘরে তার ছবি তোলা কাজ হতো অন্য ঘরে থাকতো ইজেলে টাঙানো ক্যানভাস। যখন যে কাজটা করতেন তখনই বিশ্বজগত ভুলে নিবিষ্ট মনে করতেন। প্রতিভার সঙ্গে ছিল আপ্রাণ চেষ্টা। তার আলস্য ছিল না, ছিল না বিশ্রাম। শুধু ছিল বহু শ্রমে এত করা বিদ্যা কেউ শিখতে চাইলে সেই বিদ্যা দানে তাঁর উৎফুল্লতা।
মুদ্রণশিল্পে অবদান:--
হাতে-কলমে কাজ করতে করতে তিনি আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন এবং নিজের খরচের থেকে যন্ত্রপাতি এনে নিজস্ব ছাপাখানা 'ইউ রায় এন্ড সন্স' স্থাপন করেন এবং শুরু করেন ভারতে প্রথম হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং এর কাজ। এছাড়া এই বাড়িতেই একটি ঘরে ছবি তোলার এবং ছবি আঁকার ষ্টুডিও হলো একটি ঘরে প্রেস অন্য ঘরের বারান্দার মিলে সাজানো হলো দরকারই যন্ত্রপাতি। একটি ছোট স্নানঘর হলো ডার্করুম। সেখানেই তিনি নিবিষ্টমনে হাফটোন ব্লক কে ছাপার কাজ কেমন করে আরো উন্নত করা যায় তার চর্চা করতে লাগলেন চালালেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিখলেন বিলিতি মুদ্রণ পদ্ধতি। ফটো টেকনিক সংক্রান্ত পত্রিকা 'পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল' এ প্রবন্ধ পাঠাতে লাগলেন একের পর এক। এইরকম নটি প্রবন্ধ ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত সাহেবরা তার প্রগাঢ় জ্ঞানে বিস্মিত হয়ে ছাপেন। তাঁর এই উদ্ভাবনী শক্তির ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতেও আছে। বহু বিদেশ থেকে ছাপাখানার কাজ দেখার জন্য অনেকে আসতেন তাঁর ভাড়াবাড়িতে। নিজস্ব পুঁজি, কিছু যন্ত্রপাতি এবং অসামান্য প্রতিভা- মাত্র এই তিনটি মূলধন নিয়েই তিনি করেছিলেন অসাধ্য সাধন। সে সময় ছবি ছাপা হতো কাঠের উপরে খোদাই করা উডকাট কিংবা ইস্পাতের পাতের সাহায্যে। উপেন্দ্রকিশোর বুঝেছিলেন তামা বা দস্তার পাতে খোদাই করে ছবি ছাপলে আরো পরিষ্কার এবং স্পষ্ট হবে। হাফটোন এবং লাইন ব্লক নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে তিনি যেসব উন্নত প্রণালী চালু করেছিলেন তাতে সারা পৃথিবীর মুদ্রণশিল্প উপকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ছাপাখানা আরো বড় হয়। ১৯০০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন ২২নং সুকিয়া স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে। সেখানে আত্মীয় স্বজনের আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। এমনকি চিকিৎসার প্রয়োজনে আসা এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা অনেকদিন তাঁর বাড়িতে ছিলেন। সবাইকে সেই মহিলা অতিষ্ঠ করে তুলেছিল কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের প্রসন্ন গম্ভীর ব্যক্তিত্বে তার কোনো আঁচ লাগে নি।
উপেন্দ্রকিশোর - সংগীত, মহাকাব্য এবং শিশুসাহিত্যে :-
উপেন্দ্রকিশোর শিখেছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীত। চর্চাও করতেন এবং শেখাতেনও। বেহালা ছাড়া বাজাতেন পাখোয়াজ, সেতার, হারমোনিয়াম, বাঁশি।
আর মেজো মেয়ে পূণ্যলতা "বাবার কথা" নিবন্ধে লিখেছেন, "বেহালা তাঁর যেমন প্রিয় ছিল, বেহালার হাতও ছিল তাঁর তেমনি অসাধারণ...."। তিনি যখন তন্ময় হয়ে বেহালা বাজাতেন তখন লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনতো। একবার আর মেয়ের অসুস্থতায় যখন ওষুধেও ঘুম আসত না তখন তিনি বেহালা বাজিয়ে ঘুম পাড়াতেন। পুণ্যলতা কথাই উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন কথাবার্তার মানুষ ছোট-বড় সকলের সঙ্গেই বৃষ্টি ও ভদ্র ব্যবহার করতেন শুধু তাই নয় কেউ কাউকে অভদ্রতা দেখালে তিনি তিনি চমৎকারভাবে তাকে ভদ্রতা শিখিয়ে দিতেন। একদিন পোস্ট অফিসে উপেন্দ্রকিশোর খুব ভদ্রভাবে পোস্টমাস্টার কে তার কাজ করে দিতে অনুরোধ করেন কিন্তু লোকটি খিঁচিয়ে উঠে বলে, "দেখছেন তো মশাই কাজ করছি, আমার কি চারটে হাত ?" উপেন্দ্রকিশোর শান্ত স্বরে বললেন, "কি জানি মশাই, বয়স তো হয়েছে, অনেক দেশে ঘুরেছিও, কিন্তু চারটে হাতওয়ালা পোস্টমাস্টার তো কখনো কোথাও দেখি নি, তবে দুটো হাত দিয়েই তারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজ করেন"। পোস্টমাস্টার লজ্জিত হয়ে কাজটি দ্রুত করে দেন।
বহু ধর্মসংগীত তিনি রচনা করেছেন। তার মতে পরম ব্রহ্মের কাছে নিজেকে সঁপে দিলে আর কোন ভয় থাকেনা। হাজারো কাজের ব্যস্ততার মাঝেও স্পর্শকের মত ছুঁয়ে থাকো তা হৃদয়। এখনো তার ব্রহ্মসঙ্গীত নিয়মিত ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের উপাসনায় গাওয়া হয়।
উপেন্দ্রকিশোর মনে করতেন রামায়ণ মহাভারত এই দুই মহাকাব্যে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারাগুলো মিশে আছে। এইগুলো কাছে রাখতে পারলে একা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। এজন্য তিনি ছোটদের জন্য রামায়ণ মহাভারত লিখলেন নতুন করে। আসল কাহিনী একই রইল কিন্তু গল্প বলার সৌন্দর্য চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে উঠলো। ছোটদের মত আদুরে হলেন না, বুড়োদের মত গম্ভীর হলেন না, নীতি কথার উপরে জোর দিলেন না--- খুব সুন্দর সাদা কালো রঙিন ছবি দিয়ে একেবারে ছোটদের মনের মত করে তুললেন দুই মহাকাব্যকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়বে এবং আনন্দ করে শিখবে। শিশুসাহিত্যের কোথাও মাস্টারমশাই গিরি থাকবে না--- এই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের নীতি। ভালো কাজ কাগজ ভালো রং ছাপার কালি ব্যবহার করে ভালোবেসে নিষ্ঠার সঙ্গে ছবি আঁকতেন কিন্তু ছাপা মনের মত না হলেই ফেলে দিতেন। হাফটোন ব্লক তৈরিতে কাজে গবেষণা তা তিনি পেনরোজ কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার আবিষ্কার কে কাজে লাগিয়ে কিংবা তার কাছেই কাজ শিখে কারা কারা তার সংস্থা ইউ রায় এন্ড সন্স এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল কিংবা লাখপতি হয়ে গেল তা নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না। এমনকি তিনি জমিদারি থেকে প্রাপ্য অর্থে কোনোদিন বিলাস করেননি বরং যা ব্যয় করেছেন নিজস্ব গবেষণার উন্নতির জন্য, প্রয়োজনে জমি বন্ধক রেখেছেন কিন্তু টাকা না হলে কি হবে তার চিন্তা কখনো স্পর্শ করেনি তাঁকে। শুধু ছোটদের রামায়ণ মহাভারত লেখেননি তিনি লিখেছেন আকাশের কথা বা টুনটুনির বই, এবং নানা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সংগীত ও চিত্রকলার সম্পর্ক গান বাজনার সাত সুর আর ছবি আঁকার সাত রঙের সাযুজ্য নিয়েও তার প্রবন্ধ আছে। ফটোগ্রাফি এবং প্রিন্টিং নিয়ে জটিল বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন বেচারাম ও কেনারাম গুপী গাইন ও বাঘা বাইন।
উপেন্দ্রকিশোরের চিন্তার পরিধি ছিল বহুবিস্তৃত ১৯১৩ সালে ৫০ বছর বয়সে তার দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্নপূরণের কাজে হাত দেন সেটি হল ছোটদের জন্য এক ভালো মাসিক পত্রিকা প্রকাশ। পত্রিকাটির নাম সন্দেশ ।প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে। বাংলায় ছোটদের লেখালেখির জগতে এইভাবে তিনি আনলেন এক নতুন যুগ। প্রথম সংখ্যাটি তে যেমন ছিল পাঠ্যপুস্তক বৈচিত্র্য তেমনি ছিল চকচকে ছাপা উজ্জ্বল ছবি আর আকর্ষণীয় মলাট। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য লিখতে সন্দেশ কে বেছে নিলেন দেশের বহু গুণী মানুষ যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদীশচন্দ্র বসু কুমুদ রঞ্জন মল্লিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো অনেকে। তারা বিনা পাস নাকি স্বেচ্ছায় লেখা দিতেন এবং সম্পাদক আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে নিজের পকেট থেকে, এসব তারা করতেন শুধু ছোটদের মুখ চেয়ে।
দায়ভার অর্পণ:-
১৯১৪ সালে আবার বাড়ি বদল করে এলেন ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে। তখন পুত্র সুকুমার বিলেত থেকে ফিরে এসে সন্দেশে যুক্ত হলেন আর আশ্চর্য সরস গল্প কবিতা আর তুলি দিয়ে আঁকা সাদা কালো ছবি নিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর বুঝতে পারলেন তাঁর উত্তরসূরি উপস্থিত। শরীরে বুঝতে পারছেনা ক্লান্তির অস্তিত্ব এবং ৫২ বছর বয়সে ধরা পরল ডায়াবেটিস। এরপর সন্দেশ ছেড়ে দিলেন দুই পুত্র সুকুমার ও সুবিনয়ের হাতে। তখন ডায়াবেটিসের কোন ওষুধ ছিল না, তাই বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্যের সন্ধানে ঘুরেও কোনো উন্নতি হলো না। অবশেষে ৫৩ বছরে মৃত্যুর জন্য নিজেকে তৈরি করলেন। দুশ্চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই, সেই শান্ত প্রসন্ন মুখ। কাজ করছেন, চিঠিপত্র লিখছেন, সকলের সঙ্গে দেখা করছেন আবার রোগশয্যাতেই রোজ বেহালা বাজাচ্ছেন। ব্রহ্ম চিন্তায় তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল। তিনি হাসিমুখে অমৃত লোকে যাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করতে শুরু করলেন।
শেষ যাত্রা:-
১৯১৫ সালের ২০ই ডিসেম্বর এল সেই অপেক্ষার দিন। লীলা মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "ভোর বেলায় তাঁর জানালায় এসে গান গেয়ে গেল একটি পাখি। বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়েছিলেন শোকগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজন। তাদের দিকে ফিরে স্মিত মুখে উপেন্দ্রকিশোর বলেছিলেন," পাখি কি বলে গেল জানো? সে বললে, যাও, চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।" ক্লান্তি জড়ানো গলায় বিধুমুখীকে বলেছিলেন চোখ বুঝলেই কি সুন্দর আলো দেখি। ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি পুরনো দিনের বিগত বন্ধুবান্ধব প্রিয়জনেরা কাছে এসে বসেছেন। এর মধ্যে দুঃখের স্থান কোথায়?-
ধীরে ধীরে ৫৩ বছরের পুরনো রোগক্লান্ত দেহটি পড়ে রইল- তিনি পাড়ি দিলেন চিরশান্তির জগতে। আজও শিশু-কিশোরদের জন্য যে পত্রপত্রিকার তৈরি হয় লেখালেখি ছবি আঁকা হয়, সবকিছুই নতুন রূপ পেয়েছিল পারি হাত ধরে। আজও টুনটুনির গল্প শুনে শুনে একটু বড় হওয়া শিশুরা যখন 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' এর স্বপ্ন দেখে আকাশের কথা পড়ে আবার বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকায়, সেই বিস্ময় মাখা দৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকেন চির-কিশোর সেই স্রষ্টা।
No comments:
Post a Comment