Parinam Short Story by Khushi Sarkar | পরিণাম ছোট গল্পটি লিখেছেন খুশী সরকার
ছোট গল্প— পরিণাম (Parinam) — খুশী সরকার (Khushi Sarkar
| Bengali | English |
|---|---|
| শিরোনাম — পরিণাম | Title— Parinam |
| কলমে — খুশী সরকার | Written by — Khushi Sarkar |
| বিভাগ — ছোটগল্প | Genre — Short Story |
ছোট গল্প— পরিণাম (Parinam)
খুশী সরকার (Khushi Sarkar
অমল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বড় খোসমেজাজে মানুষ। কোনোদিনই ছোটখাটো দুঃখকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। পেনশনের টাকায় সংসার মোটামুটি চলে যায়, মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে চাকরি না পেলেও ছোটোখাটো ব্যবসা করে সংসার চালিয়ে নেয়, আর কি। সংসারের ভার থেকে একেবারেই মুক্ত। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও খুব একটা ওজর আপত্তি করে না। যা পায় তা-ই দিয়েই খায় আনন্দে, একদম দিলখুশ।
তবে একটা ব্যাপারে খুব নিয়মতান্ত্রিক। সকাল বিকাল তো নিয়মমতো হাঁটেই, প্রত্যেকদিন কিন্তু বাজারে যাওয়া চা-ই, আসলে মানুষ বড় ভালোবাসে অমল। মানুষের সঙ্গে মিশতে, মানুষকে আপন করে নিতে এতোটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। তাই প্রয়োজন থাকলেও আর না থাকলেও বাজারে যেতেই হবে তাকে। বোধ হয় মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব করে নিজেকে অনেকটা ফুরফুরে রাখতে চায় কিন্তু অসুবিধা হয়েছে এই লকডাউনের দিনে, বাজার যেতে পারছে না, বয়সও হয়েছে বেশ ভালো। প্রায় আশির কাছাকাছি।
তাই বাজারে যেতে বাড়ি থেকে কিছুতেই অনুমতি মিলছে না। কি আর করা যায়! একমাত্র সম্বল বাড়ির সামনে চেয়ারে বসে থাকা। বেশ কিছুদিন ধরে লকডাউনের জেরে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। আজ চারটা বাজতেই চেয়ার নিয়ে বসে পড়েছে বাড়ির সামনে, আর কিছু না হোক, একটু ফুরফুরে বাতাস তো গায়ে লাগানো যাবে। বড্ড একঘেয়েমি টিভির খবরগুলো। করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার শুনে শুনে কেমন যেন একটা আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে মনে।
কিছুক্ষণ পরেই অনিল এসে বসলো মুখোমুখি, দরজার সামনে। আসলে এই শুনশান রাস্তাতে একটা লোক পর্যন্ত নেই। তাই অগত্যা দুজনে একটু গল্পগুজব করে সময় কাটানো। এই সময়টা যেন অনেকটা উত্তরের জানলার মত, ফুরফুরে বাতাসে মনটাকে একটু চাঙ্গা করে নেওয়া। অভ্যস্ত বিকেলটা একটু বদলে দেয় গৃহবন্দি জীবনের রঙটাকে। অনিল এসে বসতেই অমল একটু প্রসন্ন হল। বিষন্নতা কাটাতেই বলে উঠল, আর যে সময় কাটে না অনিল। ঘরে বসে বসে হাড়গুলোতে জঙ ধরে গেল। ব্যথাটাও একটু বেড়েছে দেখছি।
---আর বলো না অমল, একটু উদাস হয়েই বলে অনিল। আর কি বলতো, টিভির খবর শুনে আরো মনটা খারাপ হয়ে যায়। কত লোক যে মারা গেল, এখনো তো একইভাবে মরছে, আমাদের দেশেও তো সংখ্যাটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। বড় চিন্তার বিষয়!
— হ্যাঁ ,তাই তো। সত্যিই এমন দিন যে দেখতে হবে কোনোদিন কল্পণা করতেও পারি নি। হ্যাঁ, এর আগেও তো বিপর্যয় এসেছে,তাই না?
কিন্তু এত ভয়াবহ পরিণতি কখনো দেখিনি ভায়া। তুমি দেখেছো?
আসলে বুঝলে ভায়া, এই হচ্ছে কলিকাল, একেবারে ঘোর কলিকাল। একটা কথা চিন্তা করো তো, আমরা যেভাবে বড় হয়েছি তাতে কিন্তু মানুষের জীবনে এত চাহিদা ছিল না, টাকা রোজগারে মানুষের এত দুর্নীতিও ছিল না, আর বিলাসিতা তো ছিলই না বলতে গেলে। কিন্তু এখন দেখো, মানুষ খাওয়ার চিন্তা না করে কিভাবে সব চটকদার আসবাবপত্র, দামী দামী জামা প্যান্টে বিলাসী জীবন কাটাবে তার চিন্তাতেই় ব্যস্ত। আর এতে যদি ধার-দেনা কিংবা ছল-চাতুরীও করতে হয় , তাতেও আপত্তি নেই। এই ভাবে মানুষের মন থেকে ন্যায়-অন্যায় বোধ যেমন কমে গেছে তেমনি অন্যদিকে বাড়ছে চাহিদা। চারপাশে তো তা-ই দেখি রোজ। আর একটা জিনিস খেয়াল করেছো?
আজকাল ছেলে মেয়েরা বাবা-মার কথা একদমই শোনে না বরং বলতে গেলে বিরক্ত হয়ে বলে, ছাড়ো তো ও সব। তোমাদের কাল আর আমাদের কাল এখন অনেক ফারাক, বুঝলে ? আচ্ছা তুমিই বলো,অনিল, নিয়ম, নীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি — এগুলোর আবার একাল সেকাল কি? কিন্তু কে শোনে কার কথা! এইসব দেখে শুনে আমিও আর বাড়িতে কিছু বলি না, সব সয়ে নিয়েছি।
এতক্ষন কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল অনিল।তার কথাতেই অনিল বলে, আমার অবশ্য এসব কোনো অনিয়ম নেই। ছেলে বৌমা খুব ভালো। এখনো আমাকে অমান্য করে না। তবে বেশির ভাগ পরিবারেই ওই একই চিত্র। ঘরে ঘরে মা, বাবা, ছেলে, বউ ----প্রত্যেকের মধ্যেই একটা স্বার্থপরতা কাজ করে। সবাই নিজেকে বড় করে দেখতে চায়, আর তার ফলেই অশান্তি।
— কি আর করা যাবে অ-নি-ল! একটা উদাস ভাব ফুটে ওঠে অমলের কথায়। হঠাৎ মোবাইলটা হাতে ধরে ছুটে আসে রানী, দ্রুত বলে, তোমার ফোন,বাবা। বুঝতে পারলাম না কে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সচকিত হয়ে ফোনটা হাতে নেয় অমল, হ্যালো, হ্যালো।
— কে? কাকা?
— হ্যাঁ, কাকা বলছি।
— কে? রাম?
— হ্যাঁ।
— বল্, বল।
— একটা খবর দেওয়ার জন্য ফোন করলাম তোমাকে।
— কি খবর রে?
— একটা খারাপ খবর আছে। গত রাতে সাড়ে বারোটা নাগাদ আমার কাকা মারা গেছে।
— অ্যাঁ! কি বলছিস? আঁৎকে ওঠে অমল।
— কি করে হলো রে? এইতো গত সপ্তাহে চোখ দেখিয়ে গেল এখান থেকে। ভালোই তো ছিল শরীর ওর। হঠাৎ কি এমন হলো?
— না না, তেমন অসুখ ছিল না।
— কিভাবে হলো রে?
— ওই তো রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছে দশটা নাগাদ। তারপর আর কিছু জানিনা। কাকি ছিল না বাড়িতে। কাকার শরীর ভালো ছিল দেখেই গিয়েছিল নাতনিকে দেখতে আমরা সকালে আটটা নাগাদ দরজা বন্ধ দেখে অবাক হলাম। আমি তখন দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল, শুধু ভেজানো ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখি কাকা শুয়েই আছে, ডাকলাম কোনো উত্তর দিল না। ভয় পেয়ে শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর শক্ত আর একটুও নড়াচড়া করছে না। তখন সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পঞ্চানন ডাক্তারকে ডেকে আনলাম এবং দেখতে বললাম। উনি নাড়ী দেখেই আমাকে বললেন, উনি আর নেই, মারা গেছে। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে মারা গেছে, কিছু বুঝলেন ?
— সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তারবাবু চলে যেতেই তোমাকে ফোনটা করলাম যদি আসতে পারো একবার।
— আচ্ছা, ফোনটা তুই রাখ, দেখি আমি চিন্তা ভাবনা করে।
— ফোনের লাইন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমলবাবু।
—কি খবর ? খুবই বিষন্ন দেখাচ্ছে তোমাকে। খুবই দুঃখের খবর মারা গেছে। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করেছে।
— ও-ও তাই ! সত্যিই মর্মান্তিক খবর।
— কি হয়েছিল ?
— তেমন তেমন কিছুই না গত গত রাতে নাকি খাওয়া-দাওয়া করে দশটা নাগাদ শোয়ার পর আর বোঝা যায়নি, কখন, কিভাবে ঘটলো ঘটনাটা। একাই ছিল ভেবেই হয়তো দরজায় খিল দেয় নি, ভেজিয়ে রেখেছিল শুধু। সকাল আটটা নাগাদ উঠছে না দেখে ওর বড় দাদার ছেলে দরজা খুলে দেখে এই অবস্থা। কি ভাগ্যের পরিহাস!
বুঝলে অনিল, পৃথিবীতে সবাই সুখ পায় না, বিশেষত গরিবের জন্য তো নয়ই।
— কেন, কেন অমন কথা বলছো?
—ও বড় হতভাগ্য। মানুষ জীবনের কোনো একটা দিকে তো সুখী হয় কিন্তু ওর সব দিক শূন্য, খাঁ খাঁ মাঠ। অথচ তুমি ভাবতে পারবে না, ও ছোটবেলায় বাপ মায়ের কি আদরের ছেলে ছিল আর কি আমুদে ও রসিক!
কিন্তু সংসার করার পর জীবনে শুধু অভাব আর অভাব, তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে তবু কোনোমতে চলে যাচ্ছিল কিন্তু এমনই ভাগ্য ছেলেটার যখন নয়-দশ বছর বয়স তখন হঠাৎই একদিন বাড়ি থেকে যে কোথায় চলে গেল, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর পেল না তখন থেকেই মনে মনে ভেঙে পড়েছিল ও। কয়েক বছর পর বড় মেয়েকে বিয়ে দিল। এক সন্তান ও হলো কিন্তু জামাই বড় খারাপ, দিনরাত মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মেয়েটা নিজে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেই কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য নিজের অর্থসঙ্গতি তেমন না থাকলেও প্রানপন চেষ্টা করল কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মেয়েটাও চোখের সামনে মারা গেল। অবশেষে ছোট মেয়েটা একটু অ্যাবনরমাল ছিল, ঐরকম মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, সে টাকা তার কাছে ছিল না ফলে বিয়ে দিলো ছাপড়া জেলায়। সেখানে বরপক্ষ নিজেই টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গেল। ও ভাবল দূরে থাকলেও মেয়েটা তো ভালো থাকবে, সামাজিক গঞ্জনা তো সহ্য করতে হবে না কিন্তু এমনই পোড়া কপাল এক সন্তানের মা হয়েই় স্বামীটা মারা গেল। চোখের সামনে বিধবা মেয়ের কষ্টটা ওকে দেখতে হলো, আর এখন তো কোনো যোগই নেই।
— এই হচ্ছে মানুষের জীবন বুঝলে অনিল, অমল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আর এই জীবনের ভাঙাচোরার মধ্যে ওর শরীর খারাপ হতে থাকলো তবে সবচেয়ে খারাপ হলো চোখ দুটো। অবশ্য একটা স্বেচ্ছাসেবী দলের চেষ্টায় একটা চোখ অপারেশন করে একটু দেখতে পাচ্ছিল দ্বিতীয় চোখটা অপারেশন করার মত সাহস আর অর্থ কোনোটাই ছিল না ওর। দিন দিন যেন সন্তানের অভাব ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।
— প্রথম জীবনের আমোদ ও রসিকতা যেন কোথায় হারিয়ে গেছিল। সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন অভাব জর্জরিত কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল ও।
—সত্যি মানুষের জীবন কখন্ কোন্ খাতে বইবে — এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সব-ই তাঁর খেলা !
— কিছুক্ষণ উদাসীনভাবে চুপ থেকে অমল বলে ওঠেন, ওর তো হলো। এখন আমার জীবনের যে কি পরিণতি আছে, কে জানে ! মাঝে মাঝে এই নিয়ে ভাবলে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় সমস্ত শরীর জুড়ে।
— অত কিছু ভাবছো কেন, অমল? সবার ভাগ্য তো সমান হয় না। তোমার তো ছেলেমেয়ে আছে সামনে।
আর পেনশনের টাকাটাও তো আছে, কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
— কি জানি কি হবে? তবে মাঝে মাঝে বড় ভয় হয়। কারো ছেলে-মেয়ে থাকলেও শেষে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়, আবার কারো তেমন আপনজন না থাকলেও মৃত্যুটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে আসে। একটু ভেবে দেখো কেউ কেউ দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে কত মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে আবার কেউ হঠাৎ করেই চলে যায় মহাসমারোহে রাজার মতো।
— আরে, তোমার মৃত্যুও রাজার মতই হবে, দেখো এই বলে রাখলাম, একটু যেন প্রসন্নতা অনুভব করে অনিল।
— আসলে ভয় কোথায় বলতো অনিল, ওই মৃত্যু যন্ত্রণাটা তবে আমি দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় পড়ে পড়ে মরতে চাই না যদি এমন হতো অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ইচ্ছামৃত্যুর আইন থাকতো তাহলে আমি সেই রকম অবস্থায় পড়লে ইচ্ছামৃত্যুকেই বরণ করে নিতাম সানন্দে কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে ইচ্ছামৃত্যুর আইন এখনো পাশ হয়নি।
— তাহলে তো বড় অন্যায় হত।
— কেন, কেন?
খুব দীপ্ত স্বরে অনিল বলল, আরে বুঝলে না, আজকালকার ছেলেমেয়েরা যা স্বার্থপর তাতে ওরা রোগে ভোগা বৃদ্ধ বাবা-মাকে ইচ্ছামৃত্যু দিয়ে অমানবিক কাজ করে যেত।
— কিন্তু এখনই কি বৃদ্ধ বাবা-মা'রা খুব ভালো আছেন?
— দেখো গিয়ে এক একটা বৃদ্ধাশ্রমে ছেলে মেয়ের পথ চেয়ে কত বাবা-মা চোখের জল ফেলছেন। এটা কি কম কষ্ট ? তার চেয়ে বরং একটা ইনজেকশনে সব শেষ। নেই মৃত্যুযন্ত্রণা, নেই হা-হুতাশ, কি বলো, ভাল না?
— না না, তুমি খুব ভাবছো,অমল। যাও যাও, ঘরে যাও। একটু শুয়ে বিশ্রাম নাও, তোমার দেখছি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
— আসলে পরিণামটা আজকাল ভাবাচ্ছে খুব, বুঝলে। ঠিক আছে, তুমিও যাও ঘরে।
ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে অমল। চোখে ভেসে ওঠে ছোটবেলায় দু'জনের একসঙ্গে বড় হওয়া। মাছধরা, ডাংগুলি খেলা, স্কুল যাওয়া, আরও কত আনন্দের স্মৃতি। হঠাৎ ঘরে ঢোকে রাণী চা হাতে নিয়ে।
— তোমার মা কই ?
— ওই তো আসছে।
— কি ব্যাপার এত গুম হয়ে বসে আছো কেন? চা খা-ও।
— আমি ঠি-ক বুঝতে পারছি, তুমি কি নিয়ে ভাবছো? নিজেই তো অসুস্থ হয়ে পড়বে গো।
— আসলে খবরটা শোনার পর মনটা বড় অস্থির লাগছে। ভেসে আসছে আগের স্মৃতিগুলো। তুমি তো দেখেছো বলো, কত আমুদে ছিল কমল। তোমার সঙ্গে কত রসিকতা করেছে। কতদিন রাতে অন্যের পাতানো জাল তুলে মাছ চুরি করে এনেছি দুজনে। দু'জন দুজনকে ছেড়ে কোনো কাজই একা করতাম না আমরা অথচ দেখো স্বার্থপরের মত আমাকে রেখে একাই চলে গেল ড্যাং ড্যাং করে। নিজে নিজেই বলে যায়,যা যা স্বর্গে যা। তোর মতো হতভাগাদের এমন ভাবে যাওয়াই ভালো। তুই বড় ভাগ্যবান রে।
— আরে, একা একা কি বিড় বিড় করছো ? তুমি তো পাগল হয়ে যাবে দেখছি। এসেছি একা যেতেও হবে একা। সময় হলে সবাইকে যেতে হবে। তুমি, আমি কে? তুমি ভয় করছো অকারণ, নাও চলো এবার, তাড়াতাড়ি। তোমার শোয়ার দরকার আছে।
— হুম্ চলো। মুখে বেশী আর কথা বলল না কিংবা খবর শোনারও কোনো আগ্রহ ছিল না আজ অমলবাবুর। ঘরমুখো হতেই রানী জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তুমি রাতে খাবে না?
— না, আজ আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। লতাও আর জড়াজড়ি করল না তেমন। এত দিনের সংসারজীবন তাদের, লতা অমলবাবুকে চেনে ভালোভাবেই। তার একদিকে ভাই হারানোর কষ্টে প্রাণ ফেটে যাচ্ছে অন্যদিকে নিজের জীবনের পরিণাম — এই দুইয়ের দ্বন্ধে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তাঁর অন্তর। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লতার মনে হল যে এই ডিপ্রেশন থেকে অমলকে সরিয়ে আনতে হবে। নাহলে তো ভারী বিপদ।
তাই একটু ধমকের সুরে বলল, তুমি কি বোকা ! এত বড় কর্তব্য সচেতন, সাহসী মানুষ তুমি। কোনো বিষয়ে তো কোনোদিন হার মানো নি আর আজ যা প্রকৃতির নিয়ম, যা কেউ কোনোদিন ভাঙতে পারে নি, তা নিয়েই অকারণ ভেবে যাচ্ছো। কিন্তু একবার ভাবো তো, তোমার এই ভাবনার জন্য কি মৃত্যুকে এড়াতে পারবে, না কেউ পেরেছে কোনোদিন। তাই এই পাগলামি গুলো ছাড়ো। ঘুমোও এখন। দেখবে ঘুম হলে সব স্বাভাবিক লাগবে। মরার আগেই যদি আমরা মরার ভয়ে মরে থাকি তাহলে বাঁচাটাও তো মৃত্যুর সমান হবে, ঠিক কিনা। ভেবে দেখো । বরং অকারণ পরিণাম নিয়ে না ভেবে যে কটা দিন বাঁচা যায় একটু আনন্দে বাঁচি। সবাইকে নিয়ে হইহুল্লোড় করে জীবনটাকে উপভোগ করি।
কিন্তু কোনো কথাই যেন কানে ঢুকছিল না অমলের। একইভাবে বসে রইল গুম মেরে।এমন সময় 'ও ঠাকুর্দা, ঠাকুর্দা' বলে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো তিন্নি।ও-ও তুমি এখানে। কতক্ষন ধরে তোমাকে ডাকছি,শুনতে পাও নি। লুডো কখন খেলবে? অনেক রাত হয়ে গেল না।
ঠাকুর্দার উত্তর না পেয়ে ঠাম্মাকে বলে,ও ঠাম্মা, ঠাকুর্দা এমন করে বসে আছে কেন? আমার সঙ্গে কথাও তো বলছে না। আমি তাহলে কার সঙ্গে লুডো খেলবো?
তোর ঠাকুর্দার আজকে মন খারাপ। তাই আজকে খেলবে না। তুই একা একাই খেল আজকে,কেমন?
— না না,আমি শুনবোই না। বলেই ঠাকুর্দার হাত ধরে টানতে লাগলো,চলো না,চলো না। কেন তোমার মন খারাপ? আমি আছি না-আ। আমি সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবো হ্যাঁ,ঠাকুর্দা-আ। সবসময়ই থাকি না বলো?
— হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল অমল, চেতনা ফিরে পেল। অমনি তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, হ্যাঁ চল দিদি,তোর সঙ্গে লুডো খেলবো। তুই ঠিকই বলেছিস। তুই তো আছিস, তোর বাবা-মা মানে আমার ছেলে মেয়ে, বৌমা আছে, কিসের ভয় আমার?
— হ্যাঁ ঠিক এই ভাবে ভাবো। মরার আগে মরে কোন লাভ নেই বরং বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো,ও কতটা ভালবাসে তোমাকে, কিভাব খুঁজে বেড়াচ্ছে হন্যে হয়ে ?
— গা়ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বিছানায় অমল। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, বাঁচবো, বাঁচবো আমি, আর পরিণামের ভয়ে ভীত হবো না।
— এভাবেই সব দুঃখ কষ্ট, ভালোবাসা নিয়ে বাঁচবো।
দক্ষিণের জানলা দিয়ে তখন চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না গলে ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে ক্রমশঃ আলোকিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.